হ্যাঁ, ২০১৭ তে রসায়নবিদ্যার নোবেল এল ছবি তুলেই। এ এক আশ্চর্য ফোটোগ্রাফি যার পিছনে আছে বহু বছরের নিরলস পরিশ্রম, অসামান্য প্রজ্ঞা এবং নিবিড় অনুসন্ধিৎসা। যার ফলস্বরূপ ক্রায়ো ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের জন্য এবছরের নোবেল পেলেন তিন বিজ্ঞানী- রিচার্ড হেন্ডারসন, জাক দুবোশে এবং জোয়াকিম ফ্রাঙ্ক। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের কথা তো আমরা সবাই জানি, তাহলে কি আছে এই নতুন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে যার জন্য এই বিরাট স্বীকৃতি? আসলে এ এমন এক যন্ত্র যাতে গোপন থাকেনা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রের থেকে অতিক্ষুদ্র আণবিক পর্যায়ের ঘটনাক্রমও। তাও একেবারে ত্রিমাত্রিক ছবি ও ভিডিও সহ।
গত কয়েকবছর ধরেই নোবেল প্রাইজের জগতে ক্ষুদ্রের জয়জয়কার। ২০১৬-তে রসায়নবিদ্যার নোবেল দেওয়া হয়েছিল ন্যানো মেশিন উদ্ভাবনের জন্য। আসলে পৃথিবী এখন ছোট হতে হতে শুধু ড্রয়িং রুমের বোকা বাক্সতে নয় চলে এসেছে আঙুলের ডগাতেই। যদিও এই ‘মিনিয়েচারাইজেশন’ বা ক্ষুদ্রীকরণের সূত্রপাত কিন্তু অনেক আগেই। তার প্রথম প্রবক্তা বোধহয় রিচার্ড ফাইনম্যান। যিনি ১৯৫৯ সালে ক্যালটেকে তার সেই বিখ্যাত বক্তৃতায় প্রত্যয়ের সাথে উচ্চারণ করেন- There’s plenty of room at the bottom. শুরু হয় ছোট থেকে আরো ছোট জগতের দিকে এক আশ্চর্য যাত্রা। ক্রায়ো ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ সেই যাত্রারই এক অনবদ্য ফসল। এবার তাহলে খতিয়ে দেখা যাক কি সেই যন্ত্র।
অণুবীক্ষণ যন্ত্রের কাজই হল ক্ষুদ্র বস্তুকে বড় করে দেখানো। কিন্তু আমাদের পরিচিত আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্র বা লাইট মাইক্রোস্কোপের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। তা হল এই অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ব্যবহার করা হয় দৃশ্যমান আলোকরশ্মি যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪০০-৭০০ ন্যানোমিটার (১ ন্যানোমিটার = ১ মিটারের ১০০ কোটিভাগের এক ভাগ) এবং তা দিয়ে কোনরকমে ৩০০-৪০০ ন্যানোমিটারের বস্তু দেখা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের দেহে ভাইরাস, প্রোটিন ইত্যাদির দৈর্ঘ্য যে ১০ ন্যানোমিটার বা তার থেকেও ছোট! আর ঠিক এইখানেই দরকার হয়ে পড়ে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের কারন সেখানে আলোর পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় ইলেকট্রনের বিম বা ইলেকট্রনের সারিবদ্ধ লাইন। সব থেকে প্রচলিত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপটি হল ট্রান্সমিশন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ। কিন্তু সে যন্ত্রের সমস্যা হল জীবজ বস্তু সে যন্ত্রে দিলে ইলেকট্রনের প্রকোপে তা পুড়ে ছারখার। এক্সরশ্মির বিচ্ছুরনকে ব্যবহার করা এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির সীমাবদ্ধতা আবার অন্য জায়গায়। তার জন্য প্রয়োজন সুস্থির, নির্দিষ্ট গঠন। কিন্তু ভাইরাস, প্রোটিন, ডিএনএ এরা যে সদা সঞ্চরণশীল আর তাদের কার্যকলাপ বোঝার জন্য তাদের গতিবিধি বোঝাটাও যে বিশেষ জরুরী। আর এই সব সমস্যার সমাধানে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন সেই তিন বিজ্ঞানী- রিচার্ড হেন্ডারসন, জোয়াকিম ফ্রাঙ্ক এবং জাক দুবোশে।
কেমব্রিজের অধ্যাপক রিচার্ড হেন্ডারসন গ্লুকোজ দ্রবণ ব্যবহার করে, ইলেকট্রন বিমের শক্তিমাত্রা কমিয়ে এবং বিভিন্ন দিক থেকে তোলা দ্বিমাত্রিক ছবি জুড়ে প্রোটিন অণুর ত্রিমাত্রিক ছবি গঠন করেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোয়াকিম ফ্রাঙ্ক উপস্থাপন করেন গাণিতিক সূত্রাবলীর যার সাহায্যে আরো সূক্ষতার সাথে আরো অনেক অণুর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় এই ক্রায়ো ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ। সুইৎজারল্যান্ডের লাউসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাক দুবোশে দ্রুত শীতলীকরণের এমন এক পদ্ধতির আবিস্কার করেন যার সাহায্যে আকার অবিকৃত রেখেই ছবি তোলা সম্ভব হয় জীবজ বস্তুদের।
এই যন্ত্রের ক্রমবিবর্তন ঘটছে এবং বর্তমানে ভাইরাস, প্রোটিন অণুর গঠন এবং তাদের কর্মপদ্ধতি বোঝা হয়েছে অনেক সহজ। এর ফলস্বরূপ রোগের কার্যকারণ নির্ণয় এবং প্রতিষেধক আবিষ্কারে এই যন্ত্রের ব্যবহার হয়ে উঠছে অত্যাবশ্যক। কয়েকবছর আগে ব্রাজিলের সেই মারণ জ্বরের পিছনে থাকা জিকা ভাইরাসকে খুঁজে বের করার কৃতিত্ব কিন্তু এই যন্ত্রেরই। শুধু কি তাই? এলঝাইমার্স, ক্যান্সার চিকিৎসাতেও নতুন পথের দিশারী এই ক্রায়ো ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির সম্পাদক এলিসন ক্যাম্পবেল তাই বলেছেন, “প্রোটিন, ভাইরাসের গতিবিধি বুঝতে এ আসলে হাতে পাওয়া গুগল আর্থ”। রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি ভেঙ্কটারামন রাধাকৃষ্ণাণ বলেছেন “এই যন্ত্র জীবজ অণু এবং তাদের কার্যকলাপ স্বচক্ষে দেখার ক্ষেত্রে এ এক যুগান্তকারী বিপ্লব”।