একটি ডাক
একটি আহ্বান
একটি বজ্রকন্ঠ!
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। সেদিন সে ডাকে লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল এই বাংলার মাটিতে। ছেলে বুড়ো আবালবৃদ্ধবণিতা সকলেই তার ডাকে সাড়া দিয়েছিল। চেয়েছিল এ মাটিকে শত্রুমুক্ত করতে, একটি স্বাধীন দেশ গড়ার প্রত্যয় বুকে নিয়ে তারা যুদ্ধ করেছিল মরণপন।
ফিদেল কাস্ত্রো এ মানুষটিকে নিয়ে বলেছিলেন, “আমি হিমালয় দেখি নি কিন্তু আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি।”
আজ এই মহান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথাই বলব। ১৯৭৫ সালের এই দিনে নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন এই মানুষটি তার নিজ বাসভবনে। না, কোন বিদেশী শত্রু নয়; বরং এ দেশের মানুষেরাই হত্যা করেছিল তাকে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,
“আমার সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে এ দেশের জনগণ। আবার আমার সবচেয়ে দূর্বল দিকও হচ্ছে এ দেশের জনগণ।”
বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাদের কাছে প্রমাণ ছিল, তথ্য ছিল। এই মানুষটিকে খুন করার পাঁয়তারা চলছে। তাকে বলা হয়েছিল একটু সাবধানে থাকতে, চোখ কান খোলা রেখে চলতে। তিনি ফুঁৎকারে সব উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ দেশের মানুষের প্রতি ছিল তার অগাধ ভালোবাসা, অগাধ বিশ্বাস। এ দেশের মানুষ তাকে খুন করবে? কখনোই তা হতে পারে না!
আচ্ছা, মৃত্যুর দিন কি ভেবেছিলেন এই মানুষটি? দেশের মানুষের বিশ্বাসঘাতকতায় তার বুক থেকে এক টুকরো হতাশাও কি বের হয়ে আসে নি? হতাশায় কি তিনি চোখ মুদেছিলেন? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। প্রচন্ড ইচ্ছে করে জানতে, কেমন করে এই মানুষটির দিকে বন্দুকের নল উঁচিয়ে ধরতে পারল তারা?
পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকাকালীন সময়ে এই মানুষটি একবারের জন্যও তার সাহস হারান নি। দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন অনড়, অবিচল। পাকিস্তানীদের তাকে হত্যা করার ভয় ছিল কিন্তু তিনি সাহস ত্যাগ করেন নি। যুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত হবার পর তাকে ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। ১৯৭২ সালে জাতি বরণ করে নিল তাদের পিতাকে। পূর্ণ হল এই বাংলার বিজয়।
তবে ষড়যন্ত্র যেন পিছু ছাড়ল না। সামরিক বাহিনীর মাঝে চলছিল নানা ধরণের গুঞ্জন, ফিসফাস আর জাতির পিতাকে হত্যা করবার এক ষড়যন্ত্র। ক্ষমতার মসনদে বসবার জন্য তাদের এই ক্ষুধা ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের এই বাড়িটিতে এনেছিল দূর্যোগের এক সময়। ভোর ৫:৩০টায় শুরু হওয়া সে হত্যাযজ্ঞে জাতি হারাল চিরদিনের জন্য তাদের নতুন দিনের ভোর। সপরিবারে নিহত হলেন বঙ্গবন্ধু। বাদ যায় নি শিশু শেখ রাসেলও। সেদিন কান্না বিজড়িত কন্ঠে রাসেল বলেছিল, সে তার প্রাণভিক্ষা চায়। তার দুলাভাইয়ের সাথে প্রিয় হাসু আপা জার্মানীতে রয়েছে। সে তার হাসু আপার কাছে যেতে চায়।
কিন্তু না, মনে সেদিন দয়া হয় নি কালো পোষাক পরিহিত হত্যাকারীদের। খুন হতে হয় শিশু রাসেলকেও। সাথে ছিল শেখ জামাল, শেখ কামাল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজি জামাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাই শেখ নাসের এবং সেদিন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অবস্থান করা আরো অনেকে।
এই হত্যাকারীদের রক্ষা করতে কম জল ঘোলা করা হয় নি। নানা বর্মের আচ্ছাদনে তাদের রক্ষা করবার চেষ্টা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের অন্যতম নেপথ্য নায়ক খন্দকার মোশতাক সরকারের আমলে কুখ্যাত “ইনডেমনিটি অরডিন্যান্স” জারি করা হয়। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, নেপথ্যের অনেককেই নানা দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং তাদেরকে রক্ষা করবার চেষ্টা করা হয়। যেমন, লেফটেন্যান্ট কর্ণেল শরিফুল হক (ডালিম)-কে চীন, লেফটেন্যান্ট কর্ণেল আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনা প্রমুখ অনেককেই বিভিন্ন দেশে উচ্চপদস্থ হিসেবে নানা জায়গায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভোরে ষড়যন্ত্রকারীরা চারটি দলে বিভক্ত হয়। এদের একদল ছিল মেজর হুদার অধীনে বেঙ্গল লেন্সারের ফার্স্ট আর্মড ডিভিশন ও ৫৩৫ পদাতিক ডিভিশনের সদস্যরা যারা মুজিবের বাসভবন আক্রমণ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ও ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থানরত আনন্দবাজার পত্রিকার সংবাদদাতা সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত তাঁর “মিডনাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা” বইয়ে লিখেন যে, মুজিব হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত বর্ণনা সবসময় রহস্যে ঘনীভূত থাকবে। তিনি আরও লিখেন যে, মুজিবের বাসভবনের রক্ষায় নিয়োজিত আর্মি প্লাটুন প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করে না।
মুজিব সামরিক বাহিনীর প্রধান, কর্নেল জামিলকে টেলিফোন করে সাহায্য চান। জামিল ঘটনাস্থলে পৌঁছে সৈন্যদের সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার জন্য আদেশ দিলে তাঁকে সেখানে গুলি করে মারা হয়। মুজিবকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর দায়মুক্তি আইন বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার এবং ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মামলা করেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল তৃতীয় বিচারক মোহাম্মদ ফজলুল করিম ২৫ দিন শুনানীর পর অভিযুক্ত ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিত করেন৷
২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। খুব দ্রুতই বাকিদের বিচারের অধীনে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
১৫ আগস্ট জাতির জন্য এক শোকের দিন। এদিন জাতি হারিয়েছিল তাদের আশা ভরসার প্রতীককে। বঙ্গবন্ধুকে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কথা হয়ত কখনোই এত কম শব্দে শেষ হবে না। মানুষটাই যে ছিলেন বিশাল এক মহীরুহের মত। জাতি যেন তার আদর্শে ভবিষ্যতের দিনগুলোতে এগিয়ে যেতে পারে, এটাই হোক সকলের কাম্য।
আজ আর নয়। প্রিয়লেখার সাথেই থাকুন।