খেয়াল করে দেখবেন, বাচ্চাদের হাতে একটি চকোলেট মাফিন বা মজার সুইট রোল তুলে দেয়া হলে তারা সেটিকে খুব রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করে। একবারে খায় না কারণ, মজা তো জলদিই ফুরিয়ে যাবে। আজ এমন এক টিভি সিরিজের কথা বলব, যেটি এমনই একটি চকোলেট মাফিন ছিল। পরতে পরতে এক অমৃতের আস্বাদ কিন্তু কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে, মজাটা ভালোভাবে চেখে নেবার আগেই তা শেষ হয়ে গেল।
বলছিলাম, পারসন অব ইন্টারেস্টের কথা। আই এম ডি বি রেটিং ৮.৫, টিভি ডট কমের দেয়া রেটিং ৮.৬। মিস্টার রিজ আর হ্যারল্ড ফিঞ্চ, এই যুগলকে মনে রাখেন নি এমন টিভি সিরিজপ্রেমী পাওয়া খুব দুষ্কর। গেম অব থ্রোনস বা শার্লকের ভিড়ে এটি মানুষের মনে হয়ত অতিমাত্রায় হাইপ সৃষ্টি করতে পারে নি কিন্তু একটা কথা ঠিক। পারসন অব ইন্টারেস্টের শেষটায় হয়ত নীরবে কেঁদেছেন অনেকেই।
প্রথমেই বলে রাখছি, আমার এ লেখায় যতদূর সম্ভব স্পয়লার কম দেয়ার চেষ্টা করব। কারণ, এমন একটি সিরিজ মানুষ দেখুক, জানুক, বুঝুক। এর সাথে থাকা মানুষগুলোর প্রেমে পড়ুক সবাই। তবে তার আগে কিছুটা সিনোপসিস দেয়ার চেষ্টা করছি।
কাহিনী সংক্ষেপঃ
কাহিনীপটে হঠাৎ করেই উদয় হয় মিস্টার রিজ, একজন প্রাক্তন সি আই এর ডাকসাইটে এজেন্ট। এতোদিন তাকে ধরে নেয়া হয়েছিল মৃত হিসেবেই কিন্তু প্রথম পর্বেই তাকে দেখা যায় একজন সন্তের মত। ট্রেনে বসে আছেন, মৃদু দুলছেন ঝাঁকুনির তালে তালে।
হ্যারল্ড ফিঞ্চ, একজন বিলিয়নেয়ার সফটওয়্যার জিনিয়াস এমন একটি মেশিন আবিষ্কার করেন যেটি সর্বক্ষণ চোখ রাখছে মানুষের ওপর। তারা কি করছে, কি হচ্ছে তাদের সাথে প্রতিনিয়ত এটি জানার একটি সার্বক্ষনিক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রয়েছে তার হাতে। মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে জুলুম করা হচ্ছে, তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কিংবা ঘটানো হচ্ছে ভয়ংকর সব ঘটনা। ফিঞ্চ নিয়োগ করেন মিস্টার রিজকে। তারা দুজন মিলে শুরু করেন এক মিশন, যে মিশনে পরবর্তীতে যোগ দেন আরো কিছু মানুষ। ঘটনার নেপথ্যে থাকে আরো কিছু ঘটনা, ডিটেকটিভ ফাস্কোর মত একজন নিবেদিতপ্রাণ অফিসার কিংবা সামিন শ এর মত একজন এজেন্ট। আরো রয়েছে “রুট”। এই রুটকে ভালো না বেসে আপনি থাকতে পারবেন না, কথা দিচ্ছি। আর রয়েছে সামিন শ। চোখমুখ শক্ত করে হাতে বন্দুক থাকা এক নারী, যে কিনা মিস্টার রিজের সাথে সমানে পাল্লা দিয়ে যেতে থাকে প্রতিটি মিশনে। একসময় সরকারী দলের হাতে ধরাও পরে যায়। সে কি বের হয়ে আসতে পারে? নাকি ফিঞ্চের “টিম মেশিন” অসমাপ্তই থেকে যায়? সামারিটানই কি জয়ী হল শেষতক?
শেষ পর্যন্ত কি ঘটে এই চরিত্রগুলোর ভাগ্যে? মেশিন কি আদৌ নিজেকে রক্ষা করতে পারে? এর সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর সাথে কি ঘটে, তা ইতোমধ্যেই অনেকে জেনে গিয়েছেন। আর যারা জানেন না, তাদেরকে অবশ্যই দেখতে হবে পারসন অব ইন্টারেস্ট নামের এই মহাযজ্ঞটি।
জিম ক্যাভিয়েজেল, যিনি মিস্টার রিজের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, তাকে অনেকেই মনে করতে পারেন দ্য প্যাশন অব দি ক্রাইস্ট, ক্লাসিক চলচ্চিত্র দ্য কাউন্ট অব মন্টিক্রিস্টো কিংবা যুদ্ধের ছবি দ্য থিন রেড লাইনের মত জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোর মাধ্যমে। আজ আমার এ লেখায় কিছু কথা থাকবে ক্যাভিয়েজেলকে নিয়ে, কিছু কথা থাকবে মাইকেল এমারসন ওরফে হ্যারল্ড ফিঞ্চকে নিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, আপনি কেন এই সিরিজটি দেখবেন, তা নির্ণয়ে। শুরু করা যাক তাহলে?
প্রথমেই জিম ক্যাভিয়েজেল। ক্যারিয়ার শুরু করেন দ্য প্যাশন অব দ্য ক্রাইস্ট ছবিটি দিয়ে। মেল গিবসনের পরিচালনায় এটি ছিল তৃতীয় ছবি এবং নবাগত ক্যাভিয়েজেল এসেই বাজিমাত করেন। যদিও এই ছবিটি নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন ছিল, উঠেছিল বিতর্কও তবে হালে খুব পানি পায় নি সেগুলো। জিম খুব বেশি একটি ছবি করেন নি। তাকে যে চরিত্রগুলোর জন্য পছন্দ করা হয়েছিল, সেগুলোতে তাকে মানানসই হিসেবে কাস্ট করা হলেও একটি কারণে তিনি নাকচ করে দেন। তা হচ্ছে, “নগ্ন দৃশ্য”। কোন ধরণের নগ্ন দৃশ্যে অভিনয় করতে নারাজ ক্যাভিয়েজেল। হতে পারে, দ্য প্যাশন অব দ্য ক্রাইস্ট ছবির বিতর্ক তাকে একটু পিছিয়ে আনে। ২০০২ সালে তিনি একটি থ্রিলার ছবিতে অভিনয় করেন, নাম “হাই ক্রাইম”। এখানেও তিনি একজন প্রাক্তন সৈন্যের ভূমিকায় অভিনয় করেন, যিনি অনেকগুলো খুনের দায়ে দোষী।
পারসন অব ইন্টারেস্টে তাকে নেয়ার কারণ হিসেবে নোলান জানান,
“ক্যাভিয়েজেলের মাঝে একটা সৈনিকের ভাব রয়েছে। তার শক্ত চোয়াল ও উচ্চতা এই সিরিজের অন্যতম একটা প্লাস পয়েন্ট তো বটেই। এছাড়া সে কথাও কম বলে। আমি এমন কাউকেই চাইছিলাম।”
জনপ্রিয় সাইট দ্য গ্লোব এন্ড মেইলে লেখা একটি ব্লগে জন ডয়েল কিছু কথা বলেছেন এই সিরিজটি সম্পর্কে। নিচে তুলে দিচ্ছিঃ
প্রথমত, সিবিএসের মতে গত ১৫ বছরে পারসন অব ইন্টারেস্ট হচ্ছে সবচেয়ে “হাইয়েস্ট টেসটিং ড্রামা পাইলট” যেটি কিনা সিএসআই এর মত জনপ্রিয় টিভি সিরিজের টাইম স্লট হটিয়ে দিতে বাধ্য করেছিল।
দ্বিতীয়ত, এই সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্র কোন মানুষ নয়, একটি মেশিন। একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, যার রয়েছে চমৎকার একটি নারী কন্ঠ। এটি কোন আকাশ থেকে তুলে আনা গল্পের প্লট নয় যেখানে শুধু অবাস্তব আর কল্পনার মিশেলে তৈরি করা হয়েছে। আমেরিকান সরকার প্রতিনিয়তই তাদের নাগরিকদের ওপর কমবেশি এভাবে নজরদারি করছে। গায়ে একটু অস্বস্তির ভাব অনুভূত হলেও এ সিরিজে এ সত্যটি তুলে ধরা হয়েছে।
তৃতীয়ত, একটি সিরিজ বা ছবিকে দুর্দান্তভাবে উঠিয়ে নিয়ে আসতে পারে এর ডায়লগ। ওয়ান লাইনার বলুন কিংবা ঘটনার গভীরের কথোপকথন, পারসন অব ইন্টারেস্ট বেশ ভালোভাবেই তা উশুল করেছে।
চতুর্থত, জোনাথন নোলান। ক্রিস্টোফার নোলানের এই ভাই দ্য ডার্ক নাইট সিরিজের লেখকদের মাঝে একজন। মূলত তিনিই এই সিরিজটির স্রষ্টা। তার এই সিরিজে ব্যাটম্যানের কিছু প্রচ্ছন্ন ছায়া পাওয়া যায়। ব্যাটম্যান ডিলেমা নামক একটি টার্ম রয়েছে, যার মাধ্যমে বোঝানো হয় যে গোথাম শহরে আসলেই ব্যাটম্যানের মত একজন গার্ডিয়ান এঞ্জেলের প্রয়োজন রয়েছে কি না, তার কিছু প্রচ্ছন্ন সংকেত তিনি এই সিরিজেও দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
পঞ্চমত, জন ডয়েল মজার একটা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, গ্রেজ অ্যানাটমি কিংবা ইন দ্য সার্চ অব জি স্পটের মত জনপ্রিয় সিরিজের চাইতে পারসন অব ইন্টারেস্টের গল্পের গাঁথুনি, দৃশ্যপট ও চরিত্র বেশি আকর্ষনীয়।
মাইকেল এমারসন নাকি হ্যারল্ড ফিঞ্চ- কে বেশি জনপ্রিয়ঃ
এবার আসা যাক, মাইকেল এমারসনকে নিয়ে। বাস্তবের দুনিয়ায় তিনি আরো ভার্সেটাইল একজন চরিত্র। রাজমিস্ত্রী, শিক্ষক, ল্যান্ডস্কেপার এবং পরিচালক- সকল ধরণের কাজেই তিনি সিদ্ধহস্ত। পারসন অব ইন্টারেস্টের একটি পর্বের কথা মনে আছে? যেখানে হ্যারল্ড দেখা পেয়েছিল তার প্রিয়তমার? বাস্তবেও এমারসনের জীবনে এটির মতই একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯৪ সালে, অ্যালবামায়। অ্যালবামা স্কুল অব ফাইন আর্টসে স্নাতক হিসেবে পড়াশুনা করবার সময় শেকসপিয়রের একটি ড্রামায় অভিনয় করেন তিনি। দেখা হয়ে যায় তার সাথে ক্যারি প্রেস্টনের। সেই থেকে তাদের ভালোবাসার পথচলা শুরু। নানা দাতব্য সংস্থায় দান ধ্যান করবার জন্য মাইকেল এমারসনের বেশ সুনাম রয়েছে।পর্দায় ও পর্দার নেপথ্যে এমারসন প্রচন্ড জনপ্রিয়। দু দুটো এমি অ্যাওয়ার্ড তার ঝুলিতে রয়েছে। এছাড়াও স্যাটার্ন অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তি ও গোল্ডেন গ্লোবে তিনি নমিনেশন পেয়েছিলেন।
কিছু নেপথ্যের গল্পঃ
এবার পারসন অব ইন্টারেস্টের শ্যুটিং এর সময়কার মজার কিছু কথা আলোচনা করা যাক।
এই সিরিজের বেশিরভাগ দৃশ্যের শ্যুটিং হয়েছে নিউ ইয়র্কে। পথচারীরা প্রায়ই উঁকি দিয়ে দেখতেন আসলে হচ্ছেটা কি! নোলান একটি সাক্ষাৎকারে বলেন,
“মাঝে মাঝে আমাকে মানুষ জিজ্ঞাসা করত, এখানে কি হচ্ছে? আমি তাদের বলতাম মায়োনিজ নিয়ে একটি বিজ্ঞাপন করছি আমরা। তারা একে অন্যকে খুঁচিয়ে বলত, দেখ দেখ! লস্ট- এর নির্মাতা এখন মায়োনিজের শ্যুটিং করছে।”
ডিটেকটিভ কার্টার (তারাজি পি হেনসন) চরিত্রটির অবসান হবার পর নোলানকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে কেমন করে প্রতি সিজনে অন্তত ২২টি এপিসোড থাকবার পরেও আপনারা সিরিজটি এতটা তাজা রেখেছেন? নোলান হেসে উত্তর দেন,
“দেখতেই পাচ্ছেন! এখানে প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে!”
“পারসন অব ইন্টারেস্ট মানুষ কেন দেখবে?”- এমন একটি প্রশ্নের জবাবে প্লেজম্যান বলেন যে এটি এমন একটি গল্প যেখানে প্রতিটি গল্প অন্য গল্পটির সাথে সম্পর্কিত। আবার আপনি যদি স্ট্যান্ড এলোন এপিসোড হিসেবেও এটি দেখতে চান, তাহলেও দেখতে পারেন। এটি একটা পপ কর্ণের ব্যাগের মত। চাইলে পুরোটা খেয়ে মজা নিতে পারেন, আবার একটা একটা করে দানা মুখে দিতে পারেন ক্ষুধা মেটানোর জন্য।
রুট! এই চরিত্রটির ভূমিকার অভিনয় করেছেন এমি অ্যাকার। বলতেই হবে দশে দশ পেয়েছেন তিনি। আগেই বলেছিলাম, রুটকে ভালো না বেসে আপনি পারবেন না। প্রতিশোধের ফুলকি, পরিমিত রসবোধ আর শ’এর প্রতি ভালোবাসা- সবমিলিয়ে রুট এই সিরিজটিকে নিয়ে গিয়েছে একটি অনন্য উচ্চতায়। প্লেজম্যান ও নোলান উভয়েই একমত। রুটকে যোগ করার পর এই সিরিজটি হয়ে গিয়েছে পাঁচ পাউন্ড ওজনের একটি ব্যাগ যেখানে কুকিজ রয়েছে দশ পাউন্ড!
বেশ কিছু প্রশ্ন রেখে শেষ হয়ে যায় পারসন অব ইন্টারেস্টঃ
১) মেশিনের ভাগ্যে কি ঘটে শেষ পর্যন্ত?
২) শ এর ভাগ্যে কি ঘটল? ডিটেকটিভ ফাস্কোই বা কি ভূমিকা পালন করল?
৩) শ’কে কি বলল মেশিন? কেউ কেউ বলছেন, পারসন অব ইন্টারেস্ট আসছে স্পিন অফ নিয়ে। সেটিরই জানান দিয়ে গেল সে শ এর কাছে।
৪) আদৌ কি স্পিন অফ আসবে এই সিরিজের?
নোলানকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, “শেষ পর্যন্ত কি ঘটবে এই সিরিজের ভাগ্যে?”
তিনি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, “সবকিছুই শেষ হয়ে যাবে; শুধু একটি কুকুর ছাড়া।” কেন বলেছিলেন তিনি? মূল গল্পটিরই কি ইঙ্গিত দিলেন তিনি? নাকি হেঁয়ালি ছিল পুরোটাই? কুকুরটাই বা কার?
অনেক অনেক সব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আপনাকে দেখতে হবে পারসন অব ইন্টারেস্ট।
আজ আর নয়। প্রিয়লেখার সাথেই থাকুন, সকলের প্রিয় হয়ে উঠুন।
(তথ্যসূত্রঃ দ্য গ্লোব এন্ড মেইল ডট কম, সি বি এস ডট কম, টিভি গাইড ডট কম, ইয়াহু নিউজ ডট কম)