বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম মালটিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার। খাদ্য, পানীয়, প্রসাধানী থেকে শুরু করে চার শতাধিক ব্র্যান্ডের পণ্য আছে এই ব্রিটিশ-ডাচ কোম্পানিটির। গৃহস্থালীর পণ্য উৎপাদনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান এটি। তবে এই ইউনিলিভারের নাম এক সময় ইউনিলিভার ছিল না। ১৯৩০ সালে নেদারল্যান্ডসের কোম্পানি ‘মার্জারিন ইউনি’ এবং ব্রিটিশ কোম্পানি ‘লিভার ব্রাদার্স’ মিলে তৈরি করে ইউনিলিভার।
২০১২ সালের এক হিসাব অনুসারে, রাজস্বের দিক থেকে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে আছে এই বহুজাতিক কোম্পানি। প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল এবং নেসলের পরেই আছে ইউনিলিভার। বর্তমানে বিশ্বের ১৯০টি দেশে পণ্য বিক্রি করে তারা।
১৮৮৫ সালে লিভার ব্রাদার্স প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রিটিশ উদ্যোক্তা উইলিয়াম হেসকেথ লিভার এবং তার ভাই জেমস। এই কোম্পানিটিই বিশ্বের প্রথম প্যাকেটজাত লন্ড্রি সাবান বাজারে আনে। এর নাম ছিল সানলাইট। ১৯১৭ সালের আগ পর্যন্ত কোম্পানিটি শুধু একটি সাবানের কারখানাই ছিল। এরপর তারা খাদ্যদ্রব্যও উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে লিভার ভ্রাতৃদ্বয় মাছ, আইসক্রিম এবং বোতলজাত পানীয়ের ব্যবসা শুরু করেন।
ত্রিশের দশকে এসে নতুন যুগে পদার্পণ করে লিভার ব্রাদার্স। ডাচ কোম্পানি মার্জারিন ইউনির সঙ্গে একীভূত হয়ে শুরু করে লিভার ব্রাদার্স। এর পেছনে কারণ ছিল: মার্জারিন ইউনি প্রাণির চর্বির ব্যবসা করতো। আর সাবান কিংবা মাখন- এগুলো উৎপাদনে চর্বি প্রয়োজন হয়। পঞ্চাশের দশকে এসে ইউনিলিভার বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন, প্যাকেজিং, বাজার গবেষণা এবং বিজ্ঞাপনের দিকে মনোযোগ দেয়।
ইউনিলিভারের সবচেয়ে জনপ্রিয় পণ্যগুলোর মধ্যে লাক্স সাবান শীর্ষে। এই সাবানের জন্ম ১৯২৪ সালে ব্রিটেনে। এই ব্র্যান্ডটিই মূলত লিভার ব্রাদার্সকে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা দেয়। লাতিন ভাষায় ‘লাক্স’ অর্থ ‘আলো’। অনেকে মনে করেন, লাতিন শব্দ থেকেই ‘লাক্স’ নামটি নেয়া হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্ররা জানান, নামটি ইংরেজি ‘লাক্সারি’(luxury) শব্দকে ছোট করে নেয়া হয়।
চল্লিশের দশকে এসে আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায় ব্যবসা শুরু করে ইউনিলিভার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপজুড়ে নাৎসিদের দখলদারিত্বের কারণে সেখানে নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারেনি কোম্পানিটি। ১৯৪৩ সালে তারা কিনে নেয় খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টিজে লিপটন। ১৯৪৪ সালে কেনে পেপসোডেন্ট।
বর্তমানে ইউনিলিভারের অন্যতম সফল পণ্য সানসিল্ক শ্যাম্পু। ১৯৫৪ সালে এটি কিনে নেয় তারা। ১৯৫৭ সালে কেনে আরেকটি জনপ্রিয় প্রসাধনী পণ্য ডাভ (Dove)। এরপর একের পর এক বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্রয় অব্যাহত রাখে তারা। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে চার শতাধিক ব্র্যান্ড তাদের। এর মধ্যে ১৩টি ব্র্যান্ডকে সবচে বেশি গুরুত্ব দেয় কোম্পানি- ডাভ, ওমো, ফ্লোরা, হার্টব্র্যান্ড আইসক্রিম, হেলম্যানস, নর, লিপটন, লাক্স, ম্যাগনাম, রামা, রেক্সোনা, সানসিল্ক এবং সার্ফ। এই ১৩টি পণ্যের বাৎসরিক বিক্রি একশ কোটি ডলার।
বর্তমানে যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, চীন, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা এবং উন্নয়ন শাখা আছে ইউনিলিভারের। পশ্চিম ইউরোপের আইসক্রিম বাজারের ৩০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে তারা। ১৯৮৬ সাল থেকে স্কিন কেয়ার পণ্যে নিজেদের এগিয়ে নিতে থাকে এই মালটিন্যাশনাল কোম্পানিটি। এরপরই তারা উৎপাদন শুরু করে বিশ্ববাজার দখল করার মতো কিছু পণ্য। তৈরি করে রগু, পন্ডস, অ্যাকুয়া-নেট, কিউটেক্স এবং ভেসলিনের মতো প্রসাধনী।
১৯৯৭ সালে নিজেদের রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদনকারী কোম্পানিটি ৬১০ কোটি ডলার বিক্রি করে দেয় ইউনিলিভার। ১৯৯৮ সাল থেকে একটি কৃষি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে তারা। ২০০০ সালে প্রায় ২০৩ কোটি ডলারে কিনে নেয় বিশ্বখ্যাত খাদ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি বেন অ্যান্ড জেরিস এবং স্লিম ফাস্ট। ওই বছরই ১৩৪০ কোটি ডলারে কেনে বেস্ট ফুড। এতে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ব্যবসায়িক বিনিয়োগ বেড়ে যায়।
চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি ইউনিলিভারকে অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেয় প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্য বিক্রেতা ক্র্যাফট হাইঞ্জ। তবে ইউনিলিভার ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। লিপটন চা ও সার্ফ ডিটারজেন্ট প্রস্তুতকারক ইউনিলিভারকে অধিগ্রহণ করতে নর স্যুপ ও ট্যাং ড্রিংকের কোম্পানি ক্র্যাফট হাইঞ্জ ১৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলার দর প্রস্তাব করে।
ইউনিলিভারের প্রতিটি শেয়ারের জন্য ৩০ ডলার ২৩ সেন্ট নগদ অর্থমূল্য প্রস্তাব দেয় ক্র্যাফট হাইঞ্জ। মার্কিন কোম্পানিটি ডলারে এ মূল্য পরিশোধের কথা বলে। নগদ অর্থের পাশাপাশি ইউনিলিভারের একেকটি শেয়ারের বিপরীতে প্রস্তাবিত একীভূত কোম্পানির ইউনিট শেয়ারের দশমিক ২২ শতাংশ দেয়ার প্রস্তাব রাখা হয়। এছাড়া বৃহস্পতিবার নাগাদ ইউনিলিভারের শেয়ারের যে মূল্য ছিল, তার ১৮ শতাংশ প্রিমিয়াম দেয়ার প্রস্তাব দেয় ক্র্যাফট হাইঞ্জ। কিন্তু ক্র্যাফটের প্রস্তাবটি ‘আর্থিক ও কৌশলগত’ বিচারে আলোচনার যোগ্য নয় বলে শুক্রবার তা প্রত্যাখ্যান করে ইউনিলিভার।
ইউনিলিভারের সবচে বড় সাবসিডিয়ারি হচ্ছে ভারতের হিন্দুস্তান ইউনিলিভার। কোম্পানির নিয়ন্ত্রণকারী শেয়ারের ৬৭ শতাংশই এখানে। মূলত চারটি ভাগে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করে এই বহুজাতিক কোম্পানি: পার্সোনাল কেয়ার পণ্য, খাদ্যদ্রব্য, রিফ্রেশমেন্ট এবং হোম কেয়ার। ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইউনিলিভারের মূল্য ছিল ৫ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। এর মধ্যে ৩৬ শতাংশের মালিক পার্সোনাল কেয়ার, ২৭ শতাংশ খাদ্যদ্রব্য, ১৯ শতাংশ রিফ্রেশসেন্ট এবং ১৮ শতাংশের মালিক হোম কেয়ার। শুধু ২০১৩ সালেই কোম্পানিটি তাদের গবেষণা এবং উন্নয়ন খাতে ১১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।
জনসংযোগেও পিছিয়ে নেই তারা। গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করা বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোম্পানি ইউনিলিভার। ২০১০ সালে তারা তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন এবং প্রোমোশনে ব্যয় করেছে প্রায় ৮শ কোটি মার্কিন ডলার। বর্তমানে তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী প্রোক্টের অ্যান্ড গ্যাম্বল ও নেসলে। বিভিন্ন দেশের স্থানীয় কোম্পানিগুলো থেকেও প্রতিযোগিতার সম্মুখীন তারা। বর্তমানে ইউনিলিভারের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন পল পোলম্যান।
২০১৪ সালে সামাজিক মাধ্যম লিংকডইনের এক জরিপে সারা বিশ্বের ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে উঠে আসে ইউনিলিভার। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির যে লোগো দেখা যায় তার পেছনেও রয়েছে এক গল্প। তাদের লোগো দেখতে ইংরেজি বর্ণ ‘ইউ’র (U) মতো। এর ভেতরে আছে এলোমেলো কিছু নকশা। আমাদের কাছে এলোমেলো লাগলেও এর ভেতরে থাকা ২৫টি আইকনের নকশা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে সাজানো হয়েছে। এগুলো ইউনিলিভারের ২৫ ধরনের পণ্য এবং তাদের কোম্পানি ভ্যালুকে তুলে ধরে। যেমন: চুল দিয়ে তাদের শ্যাম্পু প্রোডাক্ট বোঝানো হয় আবার চুল মানুষের সৌন্দর্যের প্রতীক সেটা বোঝানো হয়। আর চুলের আইকনের পাশে রয়েছে ফুলের আইকন, যা ঘ্রাণ বোঝায়। এভাবে তারা ওই আইকনগুলো সুচিন্তিতভাবে বসিয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ
উইকিপিডিয়া
বিবিসি
বিজনেস ইনসাইডার