আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো নয় সে। দিনের বেলা তার ঘুমিয়ে কাটতো কফিনের ভিতরে আর সূর্য ডোবার সাথে সাথেই বের হত শিকার খুঁজতে। শিকারের গলায় শ্বদন্ত বসিয়ে রক্ত চুষে খেয়ে তবেই তার তৃষ্ণা মিটত। তার ভয়ে ট্রানসিলভেনিয়ার প্রতিটি হোটেল কক্ষে এখনও রসুনের মালা, ক্রুশ অথবা ধুন রেখে দেয়া হয়। পৃথিবীতে এই তিনটি জিনিসকেই তার যত ভয়।
বলছিলাম কাউন্ট ড্রাকুলার কথা। ব্রাম স্টোকারের “ড্রাকুলা” পড়েননি এমন মানুষ খুব কমই আছেন। এই গল্পের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে অসংখ্য চলচ্চিত্র। গল্প হলেও সত্যি যে রোমানিয়ার ট্রানসিলভানিয়ার ব্রান দুর্গ এমনই একটি দুর্গ যার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কাউন্ট ড্রাকুলার গল্প।
তবে তারচেয়েও মজার বিষয় হল এতদিন ধরে সবাই ট্রানসিলভেনিয়ার যে দুর্গটিকে ড্রাকুলার দুর্গ বলে বিশ্বাস করত,সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের “স্লেইন ক্যাসল” বলে একটি দুর্গ সেই বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। ব্রাম স্টোকারের উপন্যাসের সাথে এই দুর্গটির মিল এতই বেশি যে বাধ্য হয়ে ড্রাকুলার আসল ঠিকানা বের করা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু করে দিয়েছেন গবেষকরা। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এড়াতে তাই শুরুর থেকেই শুরু করা যাক।
ট্রানসিলভেনিয়ার ব্রান দুর্গ যেভাবে গল্পে ঠাই পেল
ব্রাসভের একটি উপশহরের মতো ছোট একটি জনপদ ব্রান। পাহাড়ের চুড়ায় সবুজ বনে ঘেরা লাল ছাদের প্রায় ৬০০ বছরের পুরনো দুর্গটি ব্রানে ঢোকার পরপরই চোখে পড়ে। রোমানিয়ার কারপাতিয়ান পর্বতমালার এই অঞ্চলে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই কার যেন চাপা, অস্পষ্ট কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। কেউ তা শুনেছে, কেউ শোনেনি।
কেউ না দেখুক বা না শুনুক, ট্রানসিলভেনিয়া এবং ওয়ালাশিয়ার সীমানায় অবস্থিত এই প্রাসাদটির দিকে তাকালেই মনে হবে এই বুঝি জানালা দিয়ে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে হাজির হল খোদ কাউন্ট ড্রাকুলা! এমন দুর্গ কিন্তু ইউরোপে খুব একটা বিরল না, তাও ব্রান দুর্গকেই ড্রাকুলার দুর্গ ধরে নিয়ে সাত সকালেই দুর্গের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে হাজার হাজার দর্শনার্থী।
ব্রান দুর্গটির ড্রাকুলার দুর্গ হয়ে ওঠার পিছনে রয়েছে এক নিষ্ঠুর ইতিহাস। শোনা যায়, ১৪৪৮ সালে ওয়ালাশিয়ার যুবরাজ তৃতীয় ভ্লাদ টেপাস জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অত্যাচারী, নিষ্ঠুর আর রক্তপিপাসু শাসক। অটোম্যান সম্রাট দ্বিতীয় মেহমুদ যখন ভ্লাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন তখন ভ্লাদের রাজধানীর কাছে এক অঞ্চলে শূলে চড়ানো ২০,০০০ মৃতদেহ দেখতে পান তারা। পাশেই একটি কবরে খোদাই করা ছিল ভ্লাদের নাম। অথচ হাজার খুঁজেও পাওয়া যায়নি ভ্লাদের মৃতদেহ। সেই থেকে ভ্লাদকেই কাউন্ট ড্রাকুলা ধরে নিয়ে ব্রান দুর্গকে কাউন্ট ড্রাকুলার দুর্গ বলে মনে করা হয়।
স্লেইনের দুর্গ তবে কোত্থেকে এলো ?
স্টোকার ১৮৮৮ সালে এক অভিনয় দলের সাথে প্রথমবারের মতো স্লেইনের দুর্গে যান। দলটি “ম্যাকবেথ” মঞ্চস্থ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। স্টোকারের ডায়েরিতেও এই দুর্গের কথা উল্লেখ করা আছে। তিনি যে স্লেইনে অতিথি হিসেবে ছিলেন তারও কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে সেখানে।
নবম আর্ল অফ এরোল, ফ্র্যান্সিস হে ১৫০০ শতকের শেষ দিকে স্লেইন দুর্গটি নির্মাণ করেন। ১৯১৩ সাল পর্যন্ত এটি রাজকীয় পরিবারের অংশ হিসেবেই ব্যবহৃত হত। তারপর স্যার জন এলারম্যান বাড়িটি কিনে নিয়ে ইজারা দিয়ে দেন। ১৯২৫ সালে ট্যাক্সের ঝক্কি এড়াতে তিনি বাড়ির ছাদ ভেঙে ফেলেন।
দুর্গটির পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে নর্থ সি, যা ক্রুডেন বের কোল ঘেঁষে রয়েছে। স্টোকারের ড্রাকুলা উপন্যাসে ড্রাকুলার বাড়ির যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তার সাথে খাপে খাপেই যেন মিলে যায় স্লেইন দুর্গের বর্ণনা। সেই একই রকম বড় বড় জানালার ফাঁক গলে নিকষ কাল আঁধারের আনাগোনায় তৈরি হওয়া মায়ার জাল যে কাউকে ড্রাকুলার দুর্গের কথা মনে করিয়ে দিতে বাধ্য!
বেশ কিছু সাহিত্যিকের মতে উপন্যাসটির প্রথমদিককার সংস্করণে ভ্যাম্পায়ারবাহী জাহাজটির হুইটবির পরিবর্তে স্লেইন উপকূলে এসে ভিড়ার কথা উল্লেখ করা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত হুইটবির কথা কোত্থেকে এলো তা একটি রহস্য। লেখক যেহেতু স্লেইনের দুর্গে ছিলেন, কাজেই এই বাড়িটিকে তিনি তার উপন্যাসের পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না, এই মতানুযায়ী ব্রান দুর্গকে টেক্কা দিয়ে ড্রাকুলার বাড়িতে পরিণত হয়েছে স্লেইনের দুর্গ।
পৃথিবীতে ভূত আছে কিনা, এলিয়েন এসেছে কিনা এমন সব চিরন্তন বিতর্কের মতোই আরেকটি বিতর্কের নাম কাউন্ট ড্রাকুলা। সবকিছু কি আর তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বিচার করা যায় ? কিছু জিনিস তো বিশ্বাস থেকেই কল্পলোকে জায়গা করে নেয়। কাউন্ট ড্রাকুলার বাড়ি ট্রানসিলভেনিয়ায় হোক আর স্কটল্যান্ডে, ভ্যাম্পায়ারে বিশ্বাসীরা কিন্তু দুটি জায়গাকেই সমানভাবে ভয়মিশ্রিত আগ্রহ নিয়েই দেখবে! এমন আরও অনেক অজানা ও বিস্ময়কর তথ্য নিয়ে সাজানো হবে প্রিয়লেখার পরবর্তী পর্বগুলোও। আমাদের সাথে থাকুন, ভাল থাকুন।