একটি দেশের চিন্তা ভাবনার স্রোত কোনদিকে বইছে, তা জানার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে দেশের তরুণ সমাজ কি পড়ছে তার দিকে দৃষ্টি দেয়া। তবে আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, দিন যতই যাচ্ছে, পড়ার মান আরো নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। এখানে পড়ার মান বলতে কেবল পাঠ্যবই কিংবা ক্লাসনোটের কথা বোঝাচ্ছি না। তাহলে কিসের কথা বোঝাচ্ছি?
এখনো মনে পড়ে, এস এস সি কিংবা এইচ এস সি পরীক্ষা দেবার সময় বড়রা উপদেশ দিতেন “আউটবই” বেশি না পড়তে। আমাদের সময়ে আউটবই পড়তে বুঝতাম তিন গোয়েন্দা, নয়ত ফেলুদা সমগ্র, কিংবা একটু ইঁচড়ে পাকামো করতে গেলে মাসুদ রানা। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে পড়ার রুচি কিংবা আগ্রহের সাথে তারতম্য ঘটতে থাকে, ঠিক তেমন পড়ার পেছনে সময় দেয়াটাও যেন মাপকাঠির দিকে বেশ তলানীর দিকে। এর কারণ কি?
কারণ আসলে অনেকগুলো রয়েছে। প্রথমত বলা যায়, আগ্রহ সৃষ্টি করতে না পারা। বর্তমানের শিশু কিশোরদের দিকে তাকিয়ে দেখুন। কোচিং, প্রাইভেট টিউটর কিংবা ক্লাসের পড়ার চাপে “আউটবই” নামক টার্মটির সাথে তারা কিভাবে পরিচিত হবে বলুন? বাবা মায়ের পাহাড়সমান প্রত্যাশা, একটি ভালো স্কুল কিংবা কলেজে ভর্তি হবার ভর্তিযুদ্ধ ইত্যাদি নানা দিক থেকে পর্যালোচনা করতে গেলে দেখা যায় যে আজকালকার বাচ্চারা গল্পের বই নামক বস্তুটির প্রতি দিন দিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
তবে প্রতি বছর একুশে বইমেলায় ঢুঁ মারলে মনের মাঝে একটু প্রশান্তি ফিরে আসে। নাহ! ছেলেমেয়েরা তো পড়ছে। তারা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চাইছে, ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইছে, বরেণ্য ব্যক্তিদের সম্পর্কে জানতে চাইছে, নানা বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিন্তু আফসোস হচ্ছে, সারা বছরব্যাপী এমন মেলার আয়োজন করা যেতে পারলে খুব ভালো হত। যেহেতু যাচ্ছে না, তাহলে বইমুখী করবার জন্য একটি ভালো উপায় কি হতে পারে?
অনেকেই একমত হবেন, অবশ্যই লাইব্রেরী। বাংলাদেশে লাইব্রেরীর সংখ্যা আশংকাজনকভাবে কম। পাবলিক লাইব্রেরীর সংখ্যা হাতে গোণা, আর প্রতিটি পাড়ায় লাইব্রেরীর সংখ্যা কত তা বাদই দেয়া যাক। হিসেবটা যদি জেলাভিত্তিক করা হয়, তাহলে ফলাফলে শিউরে উঠতে হবে। পত্রিকার নানা রিপোর্ট কিংবা খবরে দেখা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদের পড়ার বিষয় হচ্ছে চাকরির জন্য বিভিন্ন ‘দরকারী’ বই। ক্লাসের পড়া পড়বার জন্য কিংবা নিজ আগ্রহে বিভিন্ন বিষয় জানবার জন্য গমনকারী ছাত্রের সংখ্যা খুবই হাতে গোণা। কেউ কেউ হয়ত তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবেন এই কথা শুনে। কিন্তু বিষয়টি কষ্টদায়ক হলেও সত্য।
বিভিন্ন সংগঠন, অনলাইনভিত্তিক গ্রুপ, পেজ, প্রকাশনী সংস্থাগুলো প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে শিশু কিশোর থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্মের কাছে বই পৌছে দেবার জন্য। কিন্তু গ্রামের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থী, যেখানে এখনো মোম কিংবা কুপির আলোয় কায়ক্লিষ্টে পড়াশোনা করতে হয়, তাঁর মনের স্পৃহা মেটাবার জন্য লাইব্রেরীর বিকল্প আছে কি?
এতক্ষণ ধরে বলা কথাগুলো আসলে ছিল তবলার ঠুক ঠুক। মূল ছন্দে ফিরে আসা যাক এবার। আসুন, আজ একটা মজার লাইব্রেরী সম্পর্কে জানা যাক। লাইব্রেরীটি তৈরি হয় ২০১০ সালে। নির্মাতার নাম চৌ ফুজিমতো। প্রায় ৩০০০ বর্গমিটার (২৮৮৩.১৮) জায়গা নিয়ে এই লাইব্রেরীটি বিস্তৃত।
নাম হলো মুসাশিনো আর্ট ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরী। স্থান জাপানের টোকিও।
আচ্ছা, এই লাইব্রেরীটি নিয়ে আজ কেন আলোচনা করছি? তার আগে আমাদের জানতে হবে এই লাইব্রেরীটির বৈশিষ্ট্য কি। ফুজিমতো এমন একটি লাইব্রেরী বানাতে চেয়েছিলেন যেটি হবে পৃথিবীর সবচেয়ে সাধারণ লাইব্রেরী। এখানে কোন জৌলুস থাকবে না, কোন চাকচিক্য থাকবে না, এমনকি একটি সাধারণ লাইব্রেরীর যে ভাবগাম্ভীর্য থাকা উচিত, সেটিও থাকবে না। লাইব্রেরীটি হবে পাঠক আর বিপুল বইয়ের সমাহার, এই দুইয়ের মাঝে একটি সেতু তৈরি করা, যে সেতুটি কেবল মেলবন্ধনই সৃষ্টি করতে জানে। কোন ধরণের বাঁধা নয়।
আসা যাক আবার ফুজিমতোর কথায়। তাঁর মতে, একটি লাইব্রেরী তৈরি করবার জন্য চারটি জিনিসের প্রয়োজন। ব্যস, তাতেই হয়ে যাবে আপনার লাইব্রেরী মনের মত।
প্রথম উপকরণ হচ্ছে, বই।
দ্বিতীয় উপকরণ, বই রাখার স্থান বা বুক শেলফ।
তৃতীয় উপকরণ, বিপুল আলো বাতাস।
চতুর্থ উপকরণ, একটি সুন্দর স্থান।
ফুজিমতো কি তাঁর এই চারটি উপকরণের সম্মিলন ঘটাতে পেরেছেন? তিনি পেরেছেন। তাঁর তৈরি করা এই লাইব্রেরীর কাঠামো কি দিয়ে তৈরি জানেন? শুধুমাত্র বুক শেলফ। আর বাইরের আবরণটা কাঁচের তৈরি। কোন মার্বেল পাথরের গাঁথুনি নয়, ইটের তৈরি শক্ত দেয়াল নয়। শুধুমাত্র বুক শেলফ ও কাঁচ দিয়ে ফুজিমতো তৈরি করে ফেললেন পৃথিবীর অন্যতম সরল সাবলীল একটি লাইব্রেরী।
লাইব্রেরীটি মূলত সর্পিলাকার। মূল ভাবনা ছিল, এমন একটি আর্ট গ্যালারী তৈরি করা হবে যেখানে কলা ও সংস্কৃতির নানা উপাদানের সাথে জ্ঞানের ক্ষুধার পরিতৃপ্তি মেটানো যাবে, এমন একটি লাইব্রেরীও স্থাপন করা। প্রায় ২০ ফিট উঁচু উঁচু বুকশেলফগুলোই এই লাইব্রেরীর দেয়াল, বেষ্টনীর কাজ করছে।
ফুজিমতো তার এই লাইব্রেরীর সর্পিল আকৃতি প্রদান করবার জন্য নিউমেরিকাল সাহায্যও নিয়েছেন। এটি একটি বইয়ের অরণ্যের সাথেই কেবল তুলনা করা যায়। একটি “জিগজ্যাগ”, যেখানে আপনি পাবেন ১-৯ সংখ্যা বিশিষ্ট বুকশেলফের আস্তরণ। ভেতরে ঢুকলে আপনাকে বইয়ের এই অরণ্য ধীরে ধীরে গ্রাস করবে, একথা নিশ্চিত ভাবেই বলে দেয়া যায়।
জাপান থেকে এবার নিজের দেশে ফিরে আসি। একটি বটগাছ কল্পনা করি আসুন। গাছের সুশীতল ছায়ায় এক কিশোর বই পড়ছে। বইয়ের পাতায় পাতায় সে হারিয়ে যাচ্ছে নিজের কল্পনার রাজ্যে। স্বপ্ন দেখছে এমনই একটির পাঠাগার তৈরির স্বপ্ন। পাশেই বিস্তীর্ণ এক ধানখেত, মৃদুমন্দ বাতাস মাঝে মাঝে কিশোরটির চুল ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। স্বপ্ন বাস্তবায়নেরই ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে কি সে বাতাস?
আহা! কি স্বর্গীয় এক দৃশ্য! তাই না?