চলছে মাহে রমযান মাস। এই মাসটি মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র একটি মাস। ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা ইবাদত বন্দেগী করবার উদ্দেশ্যে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে তাদের ধর্মীয় উপাসনার স্থান মসজিদে। এই মসজিদ নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজনঃ
বাংলাদেশ মসজিদের দেশ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে নানা মসজিদ। স্থাপত্যের দিক থেকেই বলুন কিংবা ঐতিহাসিক ভিত্তি থেকেই বলুন, বাংলাদেশের মসজিদগুলো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে, বহন করছে নির্মাতাদের নির্মাণশৈলীর মুনশিয়ানা। ঢাকা তো বটেই, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মসজিদ এবং তাদের নির্মান কাজ দেখলে আমাদের চমকে যেতে হয়। শুধু তাই না, এই মসজিদের সাথে জড়িয়ে আছে অসংখ্য সব গাঁথা। আসুন, আজ বাংলাদেশের দুটি মসজিদ সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু তথ্য জেনে নিইঃ
১) চাটমোহর শাহী মসজিদঃ
চাটমোহর মসজিদ বাংলাদেশের একটি সুপ্রাচীন মসজিদ। পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলা হতে এটি প্রায় ২০০ গজ দূরে অবস্থিত। ইতিহাসে বর্ণিত আছে, পূর্বে চাটমোহর ছিল পাবনার একটি অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র। তখনকার সময়ে এখানে মোঘল ও পাঠানদের অবাধ বিচরণ ছিল। ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবরের সেনাপতি মাসুম খাঁ কাবলি এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এটিই আজকের চাটমোহর শাহী মসজিদ। তবে নানা বইয়ের পাতায় এটিকে মাসুম কাবলির মসজিদ বলেই উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
এই মসজিদে তুঘরা লিপিতে উৎকীর্ণ একটি ফারসি শিলালিপি ছিল। তবে বর্তমানে এই শিলালিপিটি রাজশাহী বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত আছে। লাল জাফরী ইটে নির্মিত এই মসজিদটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট। এর ভেতরে কালিমা তাইয়েবা লিখিত একটি কালো পাথর রয়েছে।
বর্তমানে মসজিদটি একটি সংরক্ষিত ইমারত।
২) বাবা আদম মসজিদঃ
পঞ্চদশ শতকে নির্মিত এই মসজিদটি বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার দরগাবাড়ি গ্রামে অবস্থিত। মসজিদের চত্বরে বাবা আদম (রহঃ) এর মাজার অবস্থিত। মসজিদটির একটু ইতিহাস রয়েছে। তবে তাঁর আগে আমাদের জানতে হবে কে এই বাবা আদম (রহঃ)।
আময়াদের সকলের জানা আছে মুন্সীগঞ্জের আদি নাম হচ্ছে বিক্রমপুর। প্রাচীন বাংলায় এই বিক্রমপুর নামটি একটি গুরুত্ব বহন করে। তা হচ্ছে, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে এবং ধর্ম প্রচার করবার ক্ষেত্রে। কারণ, বিক্রমপুর ছিল প্রাচীন বাংলার রাজধানী। প্রাচীন বাংলায় যে কয়জন সূফী সাধক ইসলাম ধর্ম প্রচার করবার জন্য ভারতবর্ষে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে বাবা আদম (রহঃ) ছিলেন অন্যতম। তাঁর পুরো নাম বাবা আদম শহীদ (রহঃ)। ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য তিনি ১২ জন আরবীয় নাবিক নিয়ে বাণিজ্য জাহাজযোগে চট্টগ্রামে পৌঁছান। তাঁর সফরসঙ্গী ১২ জন আউলিয়ার অধীনে মিশন স্থাপন করে বিভিন্ন এলাকায় ধর্মের প্রচারের জন্য ছড়িয়ে পড়েন। এদের মাঝে একজন ছিলেন সূফী শেখ মখদুম আল মুয়াসসির। তৎকালীন সময়ে বাংলার রাজা ছিলেন বল্লাল সেন। আল মুয়াসসিরের সাথে তাঁর বিরোধের দরুন তাকে টঙ্গীবাড়ির ধীপুরে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়।
এ কথা জানতে পেরে বাবা আদম শহীদ (রহঃ) বল্লাল সেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এখানে একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তা হচ্ছে, আল মুয়াসসিরকে কারারুদ্ধ অবস্থায় দেখে বল্লাল সেনের ভাগ্নে অজয় সেনের মেয়ে মাধুরী সেন ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। যার ফলশ্রুতিতে রাজা বল্লাল সেন মুসলমানদের প্রতি আরো ক্ষিপ্ত হন। ফলাফল, একটি যুদ্ধ।
এই যুদ্ধে বল্লাল সেন পরাজিত হবার আশঙ্কা করেন। তিনি বিপুল মুসলমান বাহিনী দেখে ভড়কে যান এবং বাবা আদম শহীদ (রহঃ) কে যুদ্ধ বিরতির কথা বলেন। বাবা আদম শহীদ তাঁর কথা মেনেও নেন। কিন্তু একরাতে দরগাহ বাড়িতে এশার নামাজের পর মোরাকাবা থাকা অবস্থায় বল্লাল সেন তরবারীর আঘাতে বাবা আদম শহীদ (রহঃ)কে হত্যা করেন। সময়টা ছিল ১১৭৮ সাল।
১৪৪৯ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুরের শাসক মালিক কাফুরশাহ বাবা আদমের খানকার ওপর একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এটিই বাবা আদমের মসজিদ হিসেবে খ্যাত।
মসজিদটির গম্বুজ হচ্ছে ৬টি এবং লাল পোড়ামাটির ইটে সম্পূর্ন মসজিদটি নির্মিত রয়েছে।
আজ আপনাদের বাংলাদেশের দুটি ঐতিহাসিক মসজিদের সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু জানানোর এই ছিল আমাদের প্রয়াস। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের আরো ঐতিহ্যবাহী কিছু মসজিদের আকর্ষনীয় ইতিহাস সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা করব। প্রিয়লেখার সাথেই থাকুন, ভালো থাকুন।