এডওয়ার্ড স্নোডেন : একজন সাহসী ব্যক্তিত্ব
Edward Snowden জন্ম: ২১ জুন, ১৯৮৩,আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাবেক সদস্য যিনি দেশটির ইন্টারনেট নজরদারি কর্মসূচির তথ্য ফাঁস করে দিয়ে বৈশ্বিকভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছেন।তার ফাঁস করা তথ্যের মধ্যে যেটি সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে তা হল ফেসবুক, গুগল, মাইক্রোসফট, ইয়াহু, ইউটিউব এবং অ্যাপলসহ বিভিন্ন ইন্টারনেট জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানকে না জানিয়েই তাদের সার্ভারে সরাসরি প্রবেশ করে তথ্য সংগ্রহ করে আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এনএসআই) ও ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) যা ছিল মারাত্মক এবং অসাংবিধানিক কাজ। স্নোডেনকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তাকে বলা হয়েছে একজন বীর, গোপন তথ্য ফাঁসকারী ভিন্নমতাবলম্বী বিশ্বাসঘাতক এবং দেশপ্রেমিক। স্নোডেন তাঁর কার্যকলাপ সম্বন্ধে বলেছেন যে তিনি যা করেছেন তা হল, জনগণের বিরুদ্ধে এবং তাদের নামে গোপনে যেসব করা হচ্ছে তা জনসাধারণকে অবহিত করা। অনেক মার্কিন কর্মকর্তা স্নোডেনের কার্যকলাপকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ব্যাপক ক্ষতি হিসেবে অভিহিত করেছে, অন্যদিকে অনেকে আবার তাঁর এসব কার্যকলাপকে সাধুবাদ জানিয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার।স্নোডেনের প্রকাশিত তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তা যুক্তরাষ্ট্রে এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বিষয় যেমন- জনসাধারণের উপর নজরদারি, সরকারী গোপনীয়তা এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও তথ্যের গোপনীয়তার উপর বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
শৈশব ও শিক্ষা
স্নোডেনের পুরো নাম এডওয়ার্ড জোসেফ স্নোডেন। ৩২ বছর বয়সী স্নোডেন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা রাজ্যের এলিজাবেথ সিটিতে জন্মগ্রহণ করেন ও বেড়ে উঠেন। পেনসিলভানিয়া নিবাসী তার বাবা ইউএস কোস্টগার্ডের সাবেক কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি পেন্সিলভিনিয়ায় চলে যান সেখানেই দ্বিতীয় বিয়ে করেন । ম্যারিল্যান্ডে ইউএস ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে ক্লার্ক হিসেবে কাজ করেন স্নোডেনের মা। বড় বোন একজন এটর্নি।
তিনি হাই স্কুল ঝরে পড়েন এরপর তিনি মেরিল্যান্ডের আর্নল্ডে এন্নে এরুনডেল কমিউনিটি কলেজে কম্পিউটার বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। এ কলেজ অধ্যয়নকালে তিনি আর্মি রিজার্ভের স্পেশাল ফোর্স ট্রেইনিং এ ৪ মাস কাটান। এখানে তার পা ভেঙ্গে গেলে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
ক্যারিয়ার
স্নোডেন ইউনিভারসিটি অফ মেরিল্যান্ডের সেন্টার ফর এডভান্সড ল্যাংগুয়েজের সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন।২০০৬ সালে তিনি সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিতে আই টি চাকরির মাধ্যমে তার ক্যারিয়ার এগিয়ে নিয়ে যান। ২০০৯ সালে তিনি এ চাকরি ছেড়ে প্রাইভেট কন্ট্রাক্টর হিসেবে ডেল এন্ড বুজ নামক একটি ফার্মে যোগ দেন। এরপর তিনি সাব-কন্ট্রাক্টর হিসেবে জাপানে এন এস এ-র অফিসে যান।
প্রতিবাদী আওয়াজ
তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কাজের সময় তিনি দেখেন প্রতিদিনকার নজরদারিতে এন এস এ কত সুদূর প্রসারী ছিল। এ সময় তিনি এন এস এ-র ডকুমেন্টের কপি করা শুরু করেন এবং কিছু দলিল গরে তোলেন যেখানে তিনি অসামঞ্জস্যতা খুঁজে পান। এই দলিলগুলোতে এন এস এ-র আভ্যন্তরীণ নজরদারির ব্যাপক প্রমাণ ছিল। যখন তিনি ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করলেন তখন তিনি তার সুপারভাইজারকে বললেন তার কিছু দিনের জন্য ছুটি দরকার। ২০১৩ সালের ২০ মে তিনি হংকং এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। সেখানে তিনি দ্যা গার্ডিয়ান-এর সাংবাদিক ও ছবি পরিচালক লরা পয়েত্রাস সঙ্গে গোপনে দেখা করেন। ৫ জুন দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকা গোপন নথি গুল প্রকাশ করা শুরু করে। পরের দিন দ্যা গার্ডিয়ান এবং দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট স্নোডেন থেকে পাওয়া এন এস এ-র প্রিসম কর্মসূচির তথ্য ফাঁস করা শুরু করে। এতে বলা হয় এন এস এ কিভাবে ইলেকট্রনিকালি তথ্য সংগ্রহ করে। এরকম ফাঁস করা তথ্যের বন্যা বয়ে যায় এবং সারা বিশ্বে বিতরকের ঝর ওঠে।
পরবর্তী প্রতিক্রিয়া
‘আমি আমার পূর্বের জীবন উৎসর্গ করতে চাই কারণ আমি আমেরিকার সরকারের সারা বিশ্বের জনগণের ব্যক্তিগত জীবন, ইন্টারনেট স্বাধীনতা তথা মৌলিক স্বাধীনতা উপর ব্যাপক নজরদারি কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানাতে পারি না।‘ হংকং-এ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন। তিনি তার দেশে প্রেমিকাকে ছেড়ে আসতে বাধ্য হন। এই যুগল হাওয়াই-তে এক সাথে বসবাস করতেন। কিন্তু তার প্রেমিকা ঘুণাক্ষরেও জানতেন না যে তিনি এই তথ্যগুলো প্রকাশ করতে চলেছেন।
এদিকে আমেরিকার সরকার স্নোডেনের এই কর্মকাণ্ডের আইনগত প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু করে। ২০১৩ সালের ১৪ জুন, ফেডারেল প্রসিকিউটার স্নোডেনকে সরকারি সম্পত্তি চুরি, জাতীয় প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত তথ্য অননুমোদিত উপায়ে প্রকাশ করা, অননুমোদিত ব্যক্তির নিকট শ্রেণীভুক্ত গোয়েন্দা তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে।
অন্যদিকে স্নোডেন এক মাসেরও বেশি সময় ধরে লুকিয়ে ছিলেন। তিনি প্রাথমিকভাবে ইকুয়েডরে আশ্রয় খজার জন্য পরিকল্পনা করেন কিন্তু যাত্রা বিরতিতে তিনি রাশিয়ার বিমান বন্দরে এক মাসের জন্য আটকা পড়েন যখন আমেরিকার সরকার তার পাসপোর্ট নাকচ ঘোষণা করেন। কিন্তু রাশিয়া সরকার আমেরিকা সরকারের স্নোডেনকে হস্তান্তরের অনূর্ধ্ব প্রত্যাখ্যান করে। কেউ তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করে কেউ তাকে সমর্থন করে এবং ১০০০০০ মানুষ একটি অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর করে এই জন্য যে স্নোডেনকে যেন বারাক ওবামা ক্ষমা করে দেন। পরের মাসে স্নোডেন আবার শিরোনাম হন যখন ভেনিজুয়েলা, নিকারাগুয়া ও বলিভিয়া সরকার তাকে আশ্রয় দেয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু স্নোডেন খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নেনে যে তিনি রাশিয়ায়তেই অবস্থান করবেন। তার আইনজীবী জানান স্নোডেন সাময়িকভাবে রাশিয়াতেই অবস্থান করবেন এবং পরবর্তীতে এখানে নাগরিকত্ব জন্য আবেদন করতে পারেন। স্নোডেন রাশিয়াকে ধন্যবাদ জানান এবং বলেন “অবশেষে ন্যায়ের বিজয় হয়।“ ঐ বছর অক্টোবরে তিনি জানান যে তার আর কোন ফাঁস করার মত নথি অবশিষ্ট নেই। তিনি তার সব ফাইল হংকং এর সেই সাংবাদিকের কাছে দিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তার কাছ কোন কপি রাখেননি। এরই মধ্যে স্নোডেনের বাবা তার সাথে দেখা করতে মস্কোতে আসেন।
এডওয়ার্ড স্নোডেন এর নির্বাসনের জীবন
২০১৩ সালের নভেম্বরে তিনি ইউ এস গভারমেন্টের কাছে অনুকম্পা প্রার্থনা করেন কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হন। তার প্রকাশিত তথ্যের আলোড়ন কয়েক মাস ধরে চলতে থাকে। ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সরকারি নজরদারির ভয় প্রশমনের জন্য ইউ এস এটর্নি জেনারেলকে তার দেশের নজরদারি কর্মসূচী পর্যালোচনা করার নির্দেশ দেন। নিবাসনে থাকা সত্ত্বেও স্নোডেন আলোচিত ব্যক্তিত্ব হয়ে রইলেন। আর এর মধ্যে ইউ এস মিলিটারি জানায় স্নোডেনের ফাসকৃত তথ্যের জন্য তাদের নিরাপত্তা অবকাঠামো কয়েকশ কোটি ডলার খতির মুখে পড়তে পারে।
অস্কার জেতা ‘সিটিজেনফোর’
২০১৪ সালে স্নোডেনকে নিয়ে পরিচালক পয়েত্রাস একটি ডকুমেন্টরি ফিল্ম ‘সিটিজেনফোর’ তৈরি করেন। পরিচালক তার সাথে স্নোডেনের এবং গার্ডিয়ানের সাংবাদিক গ্লেন গ্রীনওয়াল্ডের সাক্ষাৎকারটি রেকর্ড করেছিলেন। ফিল্মটি ২০১৫ সালে অস্কার জয় লাভ করে। পয়েত্রাস ও তার দল স্নোডেনের প্রেমিকাকে নিয়ে মঞ্চে উঠেন তখন তিনি ধন্যবাদ বক্তব্যে বলেন “ যখন আমাদের জীবন শাসন করার সিদ্ধান্তটি গোপনে নেয়া হয়েছিল তখন আমরা আমাদের নিজেদের শাসন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম।“ এই ফিল্মটি মুক্তির পর থেকেই স্নোডেন সরকারি নজরদারি উপর আর খোলাখুলি বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে পয়েত্রাস ও গ্লেন গ্রীনওয়াল্ডের সাথে একটি ভিডিও কনফারেন্সে দেখা যায়। ঐ মাসের শুরু দিকে স্নোডেন কানাডার আপার কলেজের ছাত্রদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে মাধ্যমে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন “ব্যাপক নজরদারির সমস্যা তখনি দেখা যায় জখন আপনি সংগ্রহ করেন সব তথ্য কিন্তু বুঝতে পারেন না কিছুই। তিনি আরও বলেন “সরকারি নজরদারি জনগণ এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভারসাম্যে মৌলিক পরিবর্তন এনেছে”।২০১৫ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে যোগ দেন। তিনি লেখেন’ আপনারা আমাকে শুনতে পান এখন?’ ২৪ ঘণ্টার ভেতরই তার ফলোয়ারের সংখ্যা দাড়ায় ২ মিলিয়ন। এর কয়েকদিন পরেই বিবিসির একটি ইন্টার্ভিউতে তিনি আমেরিকা ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং তার জন্য জেলে যেতেও রাজি আছেন।