বহু প্রতীক্ষার পর প্রকাশিত হয়েছে সঞ্জয় লীলা বানসালীর নতুন ফিল্ম ‘পদ্মাবতী’র ট্রেইলার। চিতোরের রাণী পদ্মাবতীর কাহিনী নিয়ে নির্মিত এই বিগ বাজেট মুভির ট্রেইলার এরই মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকা দর্শকদের মাঝে। এই রাণী পদ্মাবতীকে নিয়ে প্রচলিত আছে বেশ কিছু মিথ। প্রিয়লেখার পেজে আজ জেনে নিন রাণী পদ্মাবতীকে নিয়ে প্রচলিত সেই মিথগুলো।
রাণী পদ্মাবতী ছিলেন ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে চিতোরের রাজা রতন সেনের রাণী। পদ্মাবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দিন খলজী চিতোর আক্রমণ করেন পদ্মাবতীকে জয় করার জন্য। কিন্তু খলজী জয় করার পূর্বেই পদ্মাবতী অন্য রাজপুত রমণীদের নিয়ে ‘জওহর’ প্রথা পালন করে আগুনে আত্মাহুতি দেন। রাণী পদ্মাবতী সম্পর্কে এটিই সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনী হলেও এর আরও কিছু মিথের অস্তিত্ব পাওয়া যায় ইতিহাস ঘেঁটে।
মালিক মুহাম্মদ জায়সী’র ‘পদ্মাবত’ এ পদ্মাবতী:
রাণী পদ্মাবতীর কথা সর্বপ্রথম উঠে আসে মালিক মুহাম্মদ জায়সী’র ‘পদ্মাবত’ এ। এই মিথ অনুযায়ী, পদ্মাবতী ছিলেন সিংহল রাজ্যের রাজা গন্ধর্ব সেনের কন্যা। রাজকন্যা পদ্মাবতীর সাথে পরিচয় ঘটে কথা বলতে পারা এক অদ্ভুত শুকপাখির, যার নাম হীরামন। পদ্মাবতী ক্রমে যৌবনবতী হলে তাঁর রূপের সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর বিয়ে হচ্ছে না দেখে হীরামন তাকে বলে, সে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে তার উপযুক্ত বর খুঁজে আনবে। এ সংবাদ শুনে রাজা ক্রুদ্ধ হয়ে হীরামনকে হত্যা করার আদেশ দেন। পদ্মাবতী অনেক অনুরোধ করে হীরামনের প্রাণ রক্ষা করেন।
একদিন পদ্মাবতী মানসসরোবরে সখীদের সঙ্গে নিয়ে স্নান করতে গেলে হীরামন পালিয়ে যায়। হীরামন বনে এক ব্যাধের হাতে ধরা পড়ে। ব্যাধ হীরামনকে সিংহলের হাটে নিয়ে বিক্রি করতে এলে চিতোরের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আসা ব্রাহ্মণ শুকপক্ষীর জ্ঞান এবং পাণ্ডিত্যের কথা শুনে শুককে ক্রয় করে চিতোরে আসেন। শুকের কথা বলার অদ্ভুত ক্ষমতার কথা শুনে চিতোরের রাজা রতন সেন লাখ টাকা দিয়ে হীরামনকে কিনে নেন। এদিকে রাজা রতন সেনের রাণী নাগমতী শুকের কাছে পদ্মিনী রমণীগণের রূপের বর্ণনা শুনে ভাবলেন, যদি এখানে এ পাখি থাকে তাহলে একদিন না একদিন রাজা এসব শুনবেন এবং তাঁকে ছেড়ে পদ্মাবতীর জন্য গৃহত্যাগ করবেন। তিনি তাই ধাত্রীকে ডেকে শুককে হত্যা করতে আদেশ দিলেন।
রাজা ফিরে এসে শুককে না দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলে শুককে অন্তরাল থেকে তাঁর সামনে আনা হয়। শুকের মুখে পদ্মাবতীর রূপের দীর্ঘ বর্ণনা শুনে রাজা পদ্মাবতীকে পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে সঙ্গে সঙ্গে হীরামনকে সাথে নিয়ে সিংহল যাত্রা করলেন। নানা দুর্গম পথ অতিক্রম করে তাঁরা অবশেষে সিংহল দেশে মহাদেবের মন্দিরে উপস্থিত হলেন। হীরামন পদ্মাবতীর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় রতন সেনকে বলে যায়, বসন্ত পঞ্চমীর দিনে সে পদ্মাবতীর দর্শন পাবে এবং তাঁর আশা পূর্ণ হবে। অনেকদিন পর হীরামনকে পেয়ে পদ্মাবতী আনন্দে আকুল হলেন। হীরামন রাজা রতন সেনের রূপ, কুল, শৌর্য ও ঐশ্বর্য বর্ণনা করল এবং বলল, রতন সেনই সবদিক থেকে তাঁর যোগ্য পুরুষ। পদ্মাবতী রতন সেনের ত্যাগ ও প্রেমের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিলেন, বসন্ত পঞ্চমীর দিন পূজা উপলক্ষ করে রতন সেনকে দেখতে যাবেন ও তাঁকে জয়মাল্য পরিয়ে দেবেন। বসন্ত পঞ্চমীর দিন অনেক ধুমধাম করে রাজা রতন সেনের সাথে পদ্মাবতীর বিয়ে হয়। রতন সেনের সাথে যে ১৬ হাজার সঙ্গী এসেছিলেন তাদের সবার জন্য একজন করে পদ্মিনী নারী উপহার হিসেবে দেন রাজা গন্ধর্ব সেন।
নববধূ পদ্মাবতীকে নিয়ে চিতোরে ফেরার সময় সমুদ্র দেবতার অভিশাপের মুখে পরেন রাজা রতন সেন ও তার সঙ্গীসাথীরা। রতন সেনের অপরাধ ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী রমণীকে বিয়ে করে তিনি অত্যধিক অহংকারী হয়ে গিয়েছিলেন। রতন সেন ও পদ্মাবতী ছাড়া বাকি সকলেই সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়ে নিহত হন।
পদ্মাবতীকে নিয়ে চিতোরে ফিরলে রতন সেনের প্রথম স্ত্রী রাণী নাগমতীর সাথে পদ্মাবতীর বিরোধ সৃষ্টি হয়। কিছুদিন পর রাঘব চেতন নামের এক ব্রাহ্মণকে জালিয়াতির অপরাধে চিতোর থেকে নির্বাসিত করেন রতন সেন। সেই ব্রাহ্মণ গিয়ে আশ্রয় নেন দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দীন খলজীর কাছে। সেই ব্রাহ্মণের কাছ থেকে পদ্মাবতীর অপরুপ সৌন্দর্যের কথা শুনে পদ্মাবতীকে জয় করার জন্য তিনি চিতোর দখল করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করেন। কিন্তু চিতোর দুর্গ দখলে ব্যর্থ হলে তিনি রতন সেনের সাথে এক শান্তি চুক্তিতে আসতে চান। এরপর ছলের আশ্রয় নিয়ে খলজী রতন সেনকে আটক করে দিল্লী নিয়ে চলেন। পদ্মাবতী নিরুপায় হয়ে রতন সেনের অধীনস্থ গোরা ও বাদলের সাহায্য চান। তারা ছদ্মবেশ ধারণ করে দিল্লী গিয়ে রতন সেনকে উদ্ধার করেন। যুদ্ধে গোরা মারা গেলেও রতন সেন ও বাদল নিরাপদেই চিতোর ফেরেন।
এদিকে একইসময়ে চিতোরের প্রতিবেশী রাজ্য কিম্বলগড়ের রাজা দেবপালও পদ্মাবতীর রূপে আকৃষ্ট হন। রতন সেন যখন দিল্লীতে বন্দী ছিলেন, দেবপাল তখন চর মারফত পদ্মাবতীকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। রতন সেন ফিরে এসে এই কথা শুনে দেবপালকে শিক্ষা দেবেন বলে মনস্থির করেন। মুখোমুখি যুদ্ধে রতন সেন এবং দেবপাল উভয়ই মৃত্যুবরণ করেন। আর এই সুযোগে আলাউদ্দীন খলজী আরেকবার চিতোর আক্রমণ করে বসেন। নিজেদের সুরক্ষার আর কোন উপায় না দেখে নাগামতী এবং পদ্মাবতী উভয়েই রাজা রতন সেনয়ের চিতায় ঝাঁপ দেন। চিতোরের অন্য রাজপুত রমণীরাও তাদের রাণীদের দেখাদেখি আগুনে পুড়ে মরার এই ‘জওহর’ প্রথা পালন করেন।
হেমরতনের ‘গোরা বাদল পদ্মিনী চৌপাই’ অবলম্বনে পদ্মাবতী:
এই মিথ অনুযায়ী, চিতোরের রাজা রতন সেনের প্রভাবতী নামের এক রাণী ছিলেন। প্রভাবতী রান্নায় খুব ভালো ছিলেন। একদিন প্রভাবতীর রান্নায় রতন সিং অসন্তোষ প্রকাশ করেন। প্রভাবতী তখন রাজাকে চ্যালেঞ্জ করেন তার চেয়ে ভালো রাঁধতে পারে এমন কাউকে এনে দেখাতে। এক তপস্বী মারফৎ রাজা জানতে পারেন সিংহল দ্বীপের পদ্মিনী রমণীরা রান্নায় খুব পারদর্শী। রতন সেন সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সিংহল পৌঁছে সিংহলের রাজাকে দাবা খেলায় পরাস্ত করে রাজার বোন পদ্মাবতীকে বিয়ে করেন।
একদিন চিতোরে রাজা রতন সেন ও রাণী পদ্মাবতী অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর সময় রাঘব ব্যাস নামের এক ব্রাহ্মণ তাদের বিরক্ত করে ফেলেন। রাজার ভয়ে ব্রাহ্মণ দিল্লীতে আলাউদ্দিন খলজীর নিকট আশ্রয় নেন। ওই ব্রাহ্মণের কাছ থেকে খলজী পদ্মিনী নারীদের রুপ ও গুণের কথা জানতে পারেন। খলজী সিংহলে গিয়ে জানতে পারেন সিংহলের সবচেয়ে সুন্দরী নারী পদ্মাবতীর বিয়ে হয়েছে চিতোরের রাজার সাথে। খলজী তাই ২.৭ মিলিয়ন সৈন্য জোগাড় করে চিতোর আক্রমণ করেন এবং রাজা রতন সেনকে বন্দী করেন।
চিতোরের বাকি গণ্যমান্য ব্যক্তিরা রাণী পদ্মাবতীকে খলজীর হাতে তুলে দেয়াই শ্রেয় বিবেচনা করেন। কিন্তু দুই বীর যোদ্ধা গোরা ও বাদল এতে রাজি হননা। রাজপুত রমণীদের খলজীর হাতে তুলে দেয়ার নাম করে পালকি ভর্তি সৈন্য নিয়ে দিল্লী আক্রমণ করেন গোরা ও বাদল। যুদ্ধে গোরা মারা যান, আর বাদল রতন সেনকে নিয়ে চিতোর ফেরত আসেন। গোরার স্ত্রী সতী (স্বামীর চিতায় স্ত্রী জীবিত প্রবেশ করার প্রাচীন হিন্দু রীতি সতীদাহ) হন। কথিত আছে, গোরার এরূপ বীরত্বের জন্য স্বর্গে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর অর্ধেক রাজত্ব গোরাকে দিয়ে দেন।
জেমস টডের বর্ণনায় পদ্মাবতী:
উনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ লেখক জেমস টডের লেখায়ও পদ্মাবতীর কথা উঠে এসেছে। টডের ভাষ্যমতে, পদ্মাবতী ছিলেন সেয়লনের (সিংহল) চৌহান শাসক হামির সাঙ্কের কন্যা। পদ্মাবতীর বিয়ে হয় চিতোরের রাজা লছমন সিং এর আত্মীয় ভীমসিং এর সাথে। পদ্মাবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে আলাউদ্দিন খলজী চিতোর আক্রমণ করেন। অনেক বোঝাপড়ার পর ঠিক হয়, আয়নার সাহায্যে পদ্মাবতীকে একবার দেখেই বিদায় নেবেন খলজী। কিন্তু ছলের আশ্রয় নিয়ে খলজী ভীমসিংকে বন্দী করেন এবং তার মুক্তির বিনিময়ে পদ্মাবতীকে দাবি করেন। খলজীকে জানানো হয় পদ্মাবতীকে তার সখীদের সাথে দিল্লীতে পাঠানো হবে। চিতোরের দুই বীর যোদ্ধা গোরা ও বাদল রাজপুত রমণীদের বদলে পালকিতে করে চিতোরের ৭০০ দুর্ধর্ষ সৈন্য নিয়ে দিল্লী যাত্রা করেন। অতর্কিত আক্রমণে রাজাকে উদ্ধার করা গেলেও চিতোরের বহু সৈন্য এতে নিহত হন। খলজী পুনরায় বিপুল সৈন্য নিয়ে চিতোর আক্রমণ করলে ভীম সিং পরাজিত ও নিহত হন। পদ্মাবতী ও বাকি রাজপুত রমণীরা তখন আগুনে আত্মাহুতি দেন।
বাঙালি ধারণা অনুযায়ী পদ্মাবতী:
শিরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদের নাটক ‘পদ্মিনী’ (১৯০৬) রচিত হয়েছিল জেমস টডের বর্ণনার সাথে মিল রেখে। চিতোরের রাজা ছিলেন লক্ষ্মণসিংহ, আর পদ্মাবতী ছিলেন চিতোরের বীর সেনা ভীমসিংহের স্ত্রী। এরপরের কাহিনী জেমস টডের কাহিনীর অনুরূপই।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজকাহিনী’ (১৯০৯) তেও পদ্মাবতীর প্রসঙ্গ এসেছে। ভীমসিংহ পদ্মাবতীকে বিয়ে করে চিতোর নিয়ে আসেন। খলজী পদ্মাবতীর রুপের কথা শুনে চিতোর আক্রমণ করেন। মাতৃভূমি রক্ষার্থে ভীমসিংহ পদ্মাবতীকে খলজীর হাতে তুলে দিতে রাজি হন, কিন্তু চিতোরের বাকি বীরেরা এতে সায় দেয়না। যুদ্ধ করে তারা খলজীকে পরাজিত করে। কিন্তু পরবর্তীতে খলজী ভীমসিংহকে বন্দী করে তার বিনিময়ে পদ্মাবতীকে দাবি করে। গোরা ও বাদলের সাহায্য নিয়ে পদ্মাবতী তার স্বামীকে উদ্ধার করেন। একইসময়ে তৈমুর দিল্লী আক্রমণ করলে খলজীকে দিল্লী ফিরে যেতে হয়। ১৩ বছর পর ফিরে এসে খলজী আবারো চিতোর দুর্গ দখল করেন। রাজপুত পুরুষেরা সবাই যুদ্ধে নিহত হন, আর মহিলারা আগুনে আত্মাহুতি দেন।