স্হিতিশীল বলে আসলে কোন ধারনা নেই। প্রতিটি বিষয়ই পরিবর্তনশীল। কখনো ইতিবাচক, কখনো নেতিবাচক। ইতিবাচক পরিবর্তনকে আমরা বলি বিবর্তনের ধারা, আর নেতিবাচক পরিবর্তন আমরা মেনে নিতে পারিনা। শুদ্ধতার প্রয়োজনে কালপরিক্রম করে আবারো পুরনো গ্রহনযোগ্য ধারণাই ফিরে ফিরে আসে।
তেমনি ভাষা বা ভাষার প্রয়োগ। ভাষা সংক্রান্ত সকল আলোচনাকেই আমরা মনে করি গুরুগম্ভীর বা ব্যাকরন বইয়েই সীমাবদ্ধ, পুরোটাই পাঠ্যসূচীর সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু এ ধারণা একদমই ভুল। প্রাত্যহিক জীবনে ভাষার যে প্রয়োগ আমরা করি তার জন্যও ভাষার খুঁটিনাটি চর্চা করা অত্যন্ত জরুরী। বিশেষ করে লেখার ক্ষেত্রে বাক্যের সঠিক প্রয়োগ এতোটাই জরুরী যে একটু ব্যতীক্রম হলে হয়তো বাক্যের অর্থই পরিবর্তন হয়ে যায়। আর এই ধরনের ভুলের কারণে তথ্য বিভ্রান্তিসহ নানারকম জটিলতা ঘটে থাকে। লিখিত রুপ এমন হওয়া উচিত যার দ্বারা মনের ভাব অবিকৃত অবস্হায় প্রকাশ করা সম্ভব। আর সেক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় যতি এবং বিরাম চিহ্নের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
তবে সম্প্রতি এই যতিচিহ্ন এবং বিরাম চিহ্নের ব্যবহার অনেকটাই কমে গেছে। আর তার মাধ্যমে বাংলা ভাষার লেখ্য প্রয়োগে আসছে সামান্য বিকৃতি। এটাকে আমরা নেতিবাচক পরিবর্তন বলি। এতে করে মনের ভাব যথাযথ প্রকাশ করা সম্ভব হয়না।
যেমন ধরুন আপনি বলতে চেয়েছেন-
” এখানে ময়লা আবর্জনা পানি ফেলিবেন না ফেলিলে ১০০০ টাকা জরিমানা হইবে। ”
উপরোক্ত লেখাটিতে কোথাও কোন যতিচিহ্ন বা বিরামচিহ্ন ব্যবহার করা হয়নি। সেক্ষেত্রে লেখাটির অর্থ আমরা ভিন্নভাবে বুঝতেই পারি।
কেউ কেউ হয়তো বুঝবেন,
“এখানে ময়লা, আবর্জনা, পানি ফেলিবেন। না ফেলিলে ১০০০ টাকা জরিমানা হইবে। ”
কিন্তু লেখাটিতে মূলত বোঝানো হয়েছে-
“এখানে ময়লা, আবর্জনা, পানি ফেলিবেন না। ফেলিলে ১০০০ টাকা জরিমানা হইবে।”
দুটো কমা (,) চিহ্ন এবং একটি দাড়ি (।) চিহ্নের অভাবে লেখাটির অর্থ বিপরীতভাবে প্রকাশ পেয়েছ।
এবার আসি সাহিত্যের ক্ষেত্রে-
কবিতা আবৃত্তি, কন্ঠের নানারকম শৈলী এবং কন্ঠ ওঠানামার খেলা বাঞ্চনীয়। না’হলে আবৃত্তি হয়ে যায় নির্জীব। কবিতার অর্থ বা কবির মনের ভাব সঠিকভাবে প্রকাশ পায়না। নির্দিষ্ট স্হানে বিরতি, কোথাও উচ্চস্বর কোথাওবা নিম্নস্বর, এগুলোর সঠিক প্রয়োগেই আবৃত্তিগুলো একেকটি কবিতা এবং কবির একেকটি ভাষ্য হয়ে ওঠে। যুগ যুগ আগে হয়তো একজন কবি একটি কবিতা লিখে গিয়েছেন তবু আজো তাঁর সেই মনের কথা একইভাবে আমরা বুঝতে পারি তাঁর লেখনীতে যতিচিহ্ন ও বিরামচিহ্নের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে। তা নাহলে কবিতাগুলোর সাথে সাথে কবির ভাষ্যগুলোও হারিয়ে যেত।
কিন্তু সম্প্রতি আধুনিক যুগে এসে লেখার ক্ষেত্রে আমরা যতি ও বিরামচিহ্নের ব্যবহার খুবই কম করে থাকি। আর তাই সবাইকে এর প্রয়োজনীয়তা মনে করিয়ে দিতেই আজ আলোচনা করলাম বাংলা ভাষায় লেখার ক্ষেত্রে এসব চিহ্ন কতোটা জরুরী।
নিম্নে তুলে ধরছি বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত যতি ও বিরামচিহ্নসমূহ ও তাদের প্রয়োগ-
বাংলা ভাষায় নিম্নলিখিত যতিচিহ্নসমূহ ব্যবহৃত হয়:
যতিচিহ্নের নাম, আকৃতি ,বিরতি ও কালঃ
কমা বা পাদচ্ছেদ (,) : ১ (এক) বলতে যে সময় প্রয়োজন।
সেমিকোলন ( ; ):১ বলার দ্বিগুণ সময়।
দাঁড়ি বা পূর্ণচ্ছেদ (।):এক সেকেন্ড।
প্রশ্নবোধক চিহ্ন (?):ঐ
বিস্ময় ও সম্বোধন চিহ্ন(!): ঐ
কোলন( :):ঐ
ড্যাস (— ):ঐ
কোলন ড্যাস( :- ):ঐ
হাইফেন(-):থামার প্রয়োজন নেই।
ইলেক বা লোপ চিহ্ন ( ’ ):ঐ
একক উদ্ধৃতি চিহ্ন (‘ ‘ ):’এক’ উচ্চরণে যে সময় লাগে।
যুগল উদ্ধৃতি চিহ্ন( “ ”): ঐ
ব্র্যাকেট (বন্ধনি চিহ্ন) ( )
{ }
[ ] থামার প্রয়োজন নেই।
ধাতু দ্যোতক চিহ্ন √ ঐ
পরবর্তী রূপবোধক চিহ্ন < ঐ
পূর্ববর্তী রূপবোধক চিহ্ন > ঐ
সমান চিহ্ন = ঐ
বর্জন চিহ্ন … ঐ
সংক্ষেপণ চিহ্ন . ঐ
যতি বা ছেদ চিহ্নের ব্যবহারঃ
#কমা বা পাদচ্ছেদ (,)
বাক্য পাঠকালে সুস্পষ্টতা বা অর্থ-বিভাগ দেখানোর জন্য যেখানে সল্প বিরতির প্রয়োজন, সেখানে কমা ব্যবহৃত হয়।
পরস্পর সম্পর্কযুক্ত একাধিক বিশেষ্য বা বিশেষণ পদ একসঙ্গে বসলে শেষ পদটি ছাড়া সবগুলোর পরই কমা বসবে।
সম্বোধনের পর কমা বসবে।
জটিল বাক্যের অন্তর্গত প্রত্যেক খন্ডবাক্যের পর কমা বসে।
উদ্ধরণ চিহ্নের পূর্বে কমা বসবে।
মাসের তারিখ লিখতে বার ও মাসের পর কমা বসবে।
বাড়ি বা রাস্তার নম্বরের পর কমা বসে।
নামের পরে ডিগ্রিসূচক পরিচয় সংযোজিত হলে সেগুলোর প্রত্যেকটির পরে কমা বসে।
#সেমিকোলন বা অর্ধচ্ছেদ (;)
কমা অপেক্ষা বেশি বিরতির প্রয়োজন হলে, সেমিকোলন বসে।
#দাঁড়ি বা পূর্ণচ্ছেদ (।)
বাক্যের পরিসমাপ্তি বোঝাতে দাঁড়ি বা পূর্ণচ্ছেদ ব্যবহার করতে হয়।
#প্রশ্নবোধক চিহ্ন (?)
বাক্যে কোনোকিছু জিজ্ঞাসা করা হলে বাক্যের শেষে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসে।
#বিস্ময় ও সম্বোধন চিহ্ন (!)
হৃদয়াবেগ প্রকাশ করতে এ চিহ্নটি বসে।
সম্বোধন পদের পর বিস্ময়সূচক চিহ্ন ব্যবহৃত হতো; কিন্তু আধুনিক নিয়মে সম্বোধন স্থলে কমা বসে।
#কোলন (:)
একটি অপূর্ণ বাক্যের পর অন্য একটি বাক্যের অবতারণা করতে কোলন ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে উদাহারণ বোঝাতেও কোলন বহুল ব্যবহৃত।[১]
#ড্যাস (—)
যৌগিক ও মিশ্র বাক্যে পৃথক ভাবাপন্ন দুই বা তার বেশি বাক্যের সমন্বয় বা সংযোগ বোঝাতে ড্যাস বসে।
#কোলন ড্যাস (:-)
উদাহারণ বোঝাতে আগে কোলন ড্যাস ব্যবহৃত হত। বর্তমানে উদাহারণ বোঝাতে শুধু কোলন বহুল ব্যবহৃত।
#হাইফেন বা সংযোগ চিহ্ন (-)
সমাসবদ্ধ পদগুলোকে আলাদা করে দেখানোর জন্য এটি ব্যবহৃত হয়।
#ইলেক বা লোপচিহ্ন (‘)
কোনো বিলুপ্ত বর্ণের পরিবর্তে লোপ চিহ্ন বসে।
#একক উদ্ধরণ বা উদ্ধৃতি চিহ্ন (‘ ‘)
বক্তার প্রত্যক্ষ উক্তিকে এই চিহ্নের অর্ন্তভুক্ত করতে হয়।[১]
#যুগল উদ্ধরণ বা উদ্ধৃতি চিহ্ন (” “)
যদি উদ্ধৃতির ভেতরে আরেকটি উদ্ধৃতি থাকে তখন প্রথমটির ক্ষেত্রে দুই উদ্ধৃতি চিহ্ন এবং ভেতরের উদ্ধৃতির জন্য এক উদ্ধৃতি চিহ্ন হবে।[১] এছাড়াও প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতার নামের ক্ষেত্রেও যুগল উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার করা হয়।
#বন্ধনী চিহ্নঃ
বন্ধনি চিহ্ন তিন প্রকার। যেমন:
প্রথম বা বক্র বন্ধনী ( )
দ্বিতীয় বা গুম্ফ বন্ধনী { }
তৃতীয় বা সরল বন্ধনী [ ]
মূলত গণিত শাস্ত্রে এগুলো ব্যবহৃত হলেও বিশেষ ব্যাখ্যামূলক অর্থে সাহিত্যে প্রথম বন্ধনী ব্যবহৃত হয়।
আমরা যখন কথা বলি তখন যেহেতু সবগুলো বাক্য একযোগে না বলে থেমে থেমে বলি। অনেক সময় আবেগ প্রকাশ করি। কিন্তু বাক্য লিখে প্রকাশ করার সময় বিরতি ও আবেগ নির্দেশ করতে যতিচিহ্নের প্রয়োজন হয় অনস্বীকা। বাক্যে যতিচিহ্নের অশুদ্ধ ব্যবহারও ক্ষেত্রবিশেষে অর্থবিকৃতি ঘটাতে পারে।
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট