চলছে শারদীয়া দুর্গোৎসব। শরৎকালের দুর্গোৎসব শুধু উৎসব নয়, মহা-উৎসব। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, আধ্যাত্মিকতার অনুভূতি, সংস্কৃতি, বৈচিত্র্য, বাণিজ্য, বিদ্যাচর্চা, সামাজিক প্রীতির বন্ধন, হাজার বছরের বাঙালির সমন্বয় ও শান্তির ঐতিহ্যকে প্রকাশ করে। দুর্গা পূজা শুধুমাত্র বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে প্রসারিত হয়েছে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের মাঝে, সকল দেশের মানুষকে আপন করে নিতে শিখিয়ে এই উৎসবকে বিশ্বজনীন উৎসবেও পরিণত করেছে।
দুর্গা পূজার ইতিহাস বেশ পুরনো। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, সৃষ্টির আদিতে গোলকস্থ আদি বৃন্দাবনক্ষেত্রের মহারাসমন্ডলে কৃষ্ণ সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা করেন। দ্বিতীয়বার দুর্গার আরাধনা করেন ব্রহ্মা। মধু ও কৈটভ দ্বৈত্যদ্বয়ের নিধনে তিনি শরণাপন্ন হন দেবীর। ত্রিপুরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধকালে সংকটাপন্ন মহাদেব তৃতীয়বার দুর্গাপূজা করেছিলেন। এরপর দুর্বাসা মুনির শাপে শ্রীভষ্ট হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র যে দুর্গাপূজা করেন। এটা চতুর্থ দুর্গোৎসব। দেবী ভাগবত অনুসারে ব্রহ্মা ও ইন্দ্রের ন্যায় ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসনভার পেয়ে ক্ষীরোদসাগরের তীরে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মান করে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। জাগতিক মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে ঋষি মান্ডব্য, হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারে সুরথ রাজা ও বৈরাগ্য লাভের জন্য সামাধি বৈশ্য, কার্তাবির্জাজুন বধের জন্য বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম দুর্গার আরাধনা করেন।
কৃত্তিবাসের রামায়নে পাওয়া যায়, রাক্ষস রাজা রাবন বিনাশে দেবী দুর্গার শরণাপন্ন হয়েছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। তখন ছিল শরৎকাল। বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এ রামের এ অকাল বোধনের বিস্তারিত বর্ননা পাওয়া যায়। এই পুরাণের মতে, কুম্ভকর্নের নিদ্রাভঙ্গের পর রামচন্দ্রের অমঙ্গল আশঙ্কায় দেবতারা শঙ্কিত হলেন। তখন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা জানালেন , দুর্গাপূজা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। ব্রহ্মা স্বয়ং যজমানী করলেন রামের পক্ষে। তখন শরৎকাল, দক্ষিনায়ন। দেবতাদের নিদ্রার সময়। ব্রহ্মার স্তব-স্তুতিতে জাগ্রত হলেন দেবী মহামায়া। তিনি উগ্রচন্ডি রুপে আবির্ভূত হলে ব্রহ্মা বললেন, “রাবণবধে রামচন্দ্রকে অনুগ্রহ করার জন্য তোমাকে অকালে জাগরিত করেছি। যতদিন না রাবণ বধ হয়, ততদিন তোমার পূজা করব। যেমন করে আমরা আজ তোমার বোধন করে পূজা করলাম, তেমন করেই মর্ত্যবাসী যুগ যুগ ধরে তোমার পূজা করবে। যতকাল সৃষ্টি থাকবে, তুমিও পূজা পাবে এইভাবেই।” একথা শুনে চন্ডিকা বললেন, “সপ্তমী তিথিতে আমি প্রবেশ করব রামের ধনুর্বাণে। অষ্টমীতে রাম-রাবণে মহাযুদ্ধ হবে। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের দশমুন্ড বিচ্ছিন্ন হবে। সেই দশমুন্ড আবার জোড়া লাগবে। কিন্তু নবমীতে রাবণ নিহত হবেন। দশমীতে রামচন্দ্র করবেন বিজয়োৎসব।’’ রামচন্দ্রের অকাল বোধনই পরে বঙ্গদেশে প্রচার পায়, বর্তমানে যা শারদীয় দুর্গোৎসবের রুপ নিয়েছে। মহাভারতে বর্নিত আছে, শ্রীকৃষ্ণের রাজত্বকালে দ্বারকা নগরীতে কুলদেবী হিসেবে দেবী দুর্গা পূজিতা হতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে পান্ডব পক্ষের অর্জুন ও প্রদুন্ম দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন।
দুর্গা ও দুর্গাপূজা সংক্রান্ত কাহিনীগুলোর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ও লোকমান্য হল দেবীমাহাত্ম্যম্-এ বর্ণিত কাহিনীটি। দেবীমাহাত্ম্যম্ প্রকৃতপক্ষে ‘মার্কন্ডেয় পুরাণ’-এর একটি নির্বাচিত অংশ। সাতশত শ্লোকবিশিষ্ট এই দেবীমাহাত্ম্যম্-ই শ্রীশ্রী চন্ডি গ্রন্থ। চন্ডি পাঠ দুর্গোৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গও বটে। দেবীমাহাত্ম্যম্-এর কাহিনী অনুসারে পুরাকালে মহিষাসুর দেবগণকে একশ বছর ব্যাপি এক যুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল । অসুরদের অত্যাচারে পৃথিবী অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। শান্তিপুরী স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দেবগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাকে মুখপাত্র করে শিব ও নারায়ণের সমীপে উপস্থিত হন। মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনী শ্রবণ করে তারা উভয়েই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হন। সেই ক্রোধে তাদের মুখমন্ডল ভীষণাকার ধারণ করে। ইন্দ্রাদি অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হয়। সুউচ্চ হিমালয়ে স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট তেজপুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করল। ইনিই দুর্গা।
অপরদিকে দৈত্য, বিষ্ম, রোগ, পাপ, ভয় ও শত্রু হতে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। আবার মার্কন্ডেয় পুরাণমতে দুর্গম নামক অসুরকে বধ করায় দেবীর নাম হয় দুর্গা। বাঙ্গালিরা একে দশভুজারূপে পূজা করে থাকেন। দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধের মাধ্যমে দেবতাদের স্বর্গ ফিরিয়ে দিয়ে শান্তির পরশ ছড়িয়ে দেন। তাই তাকে বলা হয় দুর্গতিনাশিনী। দেবী দুর্গা শক্তির প্রতীক হিসেবে পরিচিত। আবার দুর্গাকে বলা হয় দুর্গতিনাশিনী, দুশভূজা, মঙ্গলময়ী, শক্তিদায়িনী, পরমাপ্রকৃতি, আদ্যশক্তি ও স্নেহময়ী মা। চন্ডীতে দেবীর স্তবে বলা হয়েছে ‘স্বর্গাপবর্গদে দেবী নারায়ণি নমোস্তুতে’। অর্থাৎ, ভোগের স্থান স্বর্গ লাভ করার জন্য এবং মুক্তিলাভের জন্য হে দেবী নারায়ণি, আমি তোমাকে প্রণাম জানাই। শ্রীভগবানকে মাতৃভাবে আরাধনার কথা মার্কন্ডেয় পুরাণে রয়েছে। গীতাতেও ভগবান বলেছেন- আমি জগতের মাতা। (গীতা-৯/১৭)। বাঙালি সমাজ মায়ের ভালবাসায় মুগ্ধ। ঈশ্বর সকল জীবের মা হয়ে বিরাজ করেন। ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।’