“তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারে যদি মনভার!
শ্রাবণ বরিষনে একদা গৃহকোণে
দু কথা বলি যদি কাছে তার
তাহাতে আসে যাবে কিবা কার।”
বর্ষা নিয়ে এভাবেই প্রেম বন্দনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লিখেছেন –
“এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকেনাতো মন,
কাছে যাবো কবে পাবো
ও গো তোমার নিমন্ত্রণ। ”
হ্যাঁ, বর্ষা আসলে প্রেমের ঋতু। কদমের সৌন্দর্য আর বর্ষার ঝর ঝর বারিধারা মন উদাস করে,
মনে জাগে প্রেমের আহবান।
তবে ততোক্ষনই এ প্রেম উপভোগ করা সম্ভব যতোক্ষণ বর্ষার কুৎসিক রুপটি না দেখা হয়।
হ্যা, বর্ষারও রয়েছে কুৎসিত রুপ। অর্থাৎ এ ঋতুতে বেশ কিছু রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। তাই সবার আগে জানতে হবে কি কি রোগ দেখা দেয় এবং তার প্রতিকার কি। সচেতন থেকে রোগ ব্যধির বিপত্তি এড়িয়ে চলতে পারলেই এ ঋতুর সৌন্দর্য সম্পূর্ণরুপে উপভোগ করা সম্ভব।
তাই কথা বলেছিলাম ডঃ নুরূল হুদা জনি,
এমবিবিএস, পিজিটি (মেডিসিন), সিসিডি(ডায়াবেটলজি)
রেজিস্টার, ডিপার্টমেন্ট অব মেডিসিন,
আকিজ মেডিকেল কলেজ হসপিটাল, খুলনা।
তাঁর কাছেই জেনে নেই এই ঋতুর উল্লেখযোগ্য ব্যধি এবং তার প্রতিকার সম্পর্কে-
ইনফ্লুয়েঞ্জাঃ
সাধারণত এ ঋতুতে ইনফ্লুয়েঞ্জা অর্থাৎ সর্দি, কাশি, জ্বর, মাথাব্যথা দেখা দেয়। এটা আসলে ভাইরাসের আক্রমণে হয়ে থাকে। এ ভাইরাস যদি শরীরে আরো বেশী দানা বাঁধে তখন দেখা দেয় ট্রাকিয়ো ব্রঙ্কাইটিস নিউমোনিয়া।
লক্ষণঃ ৩-৫ দিন অতিরিক্ত জ্বর থাকবে, গায়ে খিচুনী দেবে, প্রচন্ড সর্দি কাশি হবে, নাক দিয়ে পানি ঝরবে।
কারণঃ সাধারণত স্যাঁতসেতে পরিবেশে থাকলে, বেশী ঠান্ডা লাগালে, বৃষ্টির পানিতে ভিজলে এ রোগ উৎপন্ন হয়।
প্রতিরোধঃ স্যাঁতসেতে অস্বাস্হ্যকর পরিবেশ এড়িয়ে চলা, বৃষ্টির পানিতে ভিজলে পরক্ষনেই স্বাভাবিক পানি দিয়ে গোসল করে নেয়া।
সমাধানঃ ঠান্ডা লাগানো থেকে বিরত থাকতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওসুধ সেবন করতে হবে।
নখে ফাংগাস আক্রমণ অর্থাৎ প্যারোনাইকিয়াঃ
সাধারণত বর্ষাকালে রাস্তা-ঘাটে কাঁদা সৃষ্টি হয়। কয়েকদিন অনবরত বৃষ্টি হলে পঁচা কাঁদার সৃষ্টি হয়। এসময় পায়ে কাঁদা লেগে নখের ভেতরে সেসব পঁচা কাঁদা আটকে থাকলে নখে ফাংগাল আক্রমণ হয়। সেখান থেকেই প্যারোনাইকিয়া হতে পারে।
লক্ষণঃ নখের পাশ কালো হয়ে যাওয়া, ভিতরে পুঁজ সৃষ্টি হওয়া এবং ব্যথা অনুভূত হওয়া।
প্রতিরোধঃ কাঁদা এড়িয়ে চলা, কাঁদা লাগলে দ্রুত পা এবং নখের ভিতরে ভালোভাবে পরিষ্কার করে ধুয়ে ফেলা।
সমাধানঃ একবার আক্রমনের স্বীকার হলে দ্রুত নিকটস্থ মেডিসিন ডাক্তারের স্মরনাপন্ন হওয়া।
ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়াঃ
বর্ষাকালে ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়ার প্রকোপ উল্লেখযোগ্য। বিশেষকরে শহরাঞ্চলে ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়ার আক্রমন বেশী। এডিস নামক এক প্রকার স্ত্রী মশার কামড়ে ডেঙ্গু বা চিকনগুনিয়া হয়।
লক্ষণঃ এ রোগ আক্রমণ করলে গায়ে প্রচন্ড জ্বর এবং জয়েন্ট পেইনসহ সারা শরীরে অসহনীয় ব্যথা অনুভূত হবে। গায়ে লাল লাল ফুসকুড়ি দেখা দেবে।
প্রতিরোধঃ সাধারণত জমে থাকা পানিতে, ঝোপ জঙ্গলেই এডিস মশার জন্ম হয়। তাই বাড়ির আশেপাশে ঝোপ জঙ্গল জন্মাতে দেবেন না। ডোবা বা জলাশয়ের পঁচা পানি জমতে দেবেন না। পুরনো কৌটা, ডাবের খোসা, টায়ার, ফুলের টব বা ঘরের আঙিনায় পানি জমে পঁচতে দেওয়া যাবেনা কারণ, এসব পানিতেই এডিস মশা জন্ম নয়।
সমাধানঃ এরকম লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত নিকটস্থ মেডিসিন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে এবং নিয়মিত ওসুধ সেবন করতে হবে।
ম্যালেরিয়াঃ
বর্ষাকালে ম্যালেরিয়া রোগ দেখা দিতে পারে। ম্যালেরিয়াও একটি মশা বাহিত রোগ। স্ত্রী অ্যানোফেলিস মশা কামড়ালে ম্যালেরিয়া রোগ হয় । এটি একটি ভয়াবহ রোগ যা অবহেলা করলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
লক্ষণঃ প্রচন্ড জ্বর, গায়ে ব্যথা ও মাথায় ব্যথা।
প্রতিরোধঃ বাড়ির ভিতরে ও আশেপাশে কোথাও পানি জমতে দেওয়া যাবেনা যেখানে মশা উৎপন্ন হতে পারে। মশার প্রকোপ রয়েছে এরকম স্হান যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে।
সমাধানঃ এ রোগের কোন লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
হেপাটাইটিস বিঃ
হেপাটাইটিস বি একটি পানিবাহিত সাথে সাথে ভাইরাসজনিত রোগ। হেপাটাইটিস ভাইরাস লিভার কে আক্রমণ করে
রক্তে বিলিরুবিন এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয় তখন জন্ডিস দেখা দেয়। বর্ষাকালে এ রোগের প্রকোপ দেখা দেয়।
লক্ষণঃ শরীরে পানি শূণ্যতা দেখা দেয়। শরীর শুকিয়ে যায়। চোখ ও নখ হলুদাভ হয়, পায়খানা কালো ও কড়া হয়, খাবার রুচি নষ্ট হয়ে যায় এমনকি বমি বমি ভাব এবং বমিও হতে পারে।
প্রতিরোধঃ খাবার পানি যেন কোনভাবেই দূষিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এরকম ভাইরাস বহন করছে এমন কারো গ্লাসে বা প্লেটে এমনকি একই খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। রাস্তার পাশে আখের রস, শরবত এগুলো খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
সমাধাণঃ প্রচুর পরিমান ঠান্ডা পানি পান করতে হবে, ঘরে তৈরী নিরাপদ শরবত, আখের রস এবং ডাবের পানি খেতে হবে। নিয়মিত গোসল করতে হবে। তেল, মসলা জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। এমন লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত নিকটস্থ মেডিসিন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে এবং নিয়মিত প্রয়োজনীয় ওসুধ ফুল কোর্স সেবন করতে হবে।
টাইফয়েডঃ
টাইফয়েড ও একটি পানিবাহিত রোগ। বর্ষায় এ রোগ দেখা দেয়।
salmonella typhi নামক ব্যাক্টেরিয়া থেকে টাইফয়েড হয়।
দুষিত পানি পঁচা বাশি খাবার খেলে টাইফয়েড হতে পারে।
লক্ষণঃ অনেক জ্বর, মাথায় যন্ত্রনা, মাথা ঘোরে, সারাক্ষণ বমি বমি ভাব এবং বমি হয়, খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে যায়।
প্রতিরোধঃ বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে, পঁচা বাশি খাবার খাওয়া যাবেনা।
সমাধানঃ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযারী নিয়মিত ফুল কোর্স ওসুধ এবং ইনজেকশন দরকার হলে নিয়মিত ফুল কোর্স ইনজেকশন সম্পন্ন করতে হবে।
ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়ঃ
ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয় এগুলো পানিবাহিত রোগ যা বর্ষাকালে হয়ে থাকে। সব বয়সের মানুষেরই এ রোগ হয় তবে শিশুদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশী।
লক্ষণঃ পেটে কামড় দিয়ে ব্যথা, পাতলা পায়খানা, বমি এগুলো ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়ের লক্ষণ।
প্রতিরোধঃ দূষিত পানি, পঁচা বাশি খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। স্যাঁতসেতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এড়িয়ে চলতে হবে।
সমাধানঃ এসময় শরীর থেকে অনেক তরল বেরিয়ে যায় তাই প্রচুর বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে, স্যালাইন খেতে হবে, ডাবের পানি ও শরবত খেতে হবে। অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওসুধ সেবন করতে হবে।
কৃমি রোগঃ
বর্ষাকালে চারপাশ ভেজা থাকে এবং কাঁদা সৃষ্টি হয়। এসময় স্যাঁতসেত পরিবেশ থেকে শরীরে কৃমির ডিম্বানু প্রবেশ করতে পারে।
লক্ষণঃ অতিরিক্ত পেটে ব্যথা ও বমি বমি ভাব, ক্ষুধামন্দা এবং বমি হতে পারে।
প্রতিরোধঃ নোংরা স্যাঁতসেতে জায়গা এড়িয়ে চলতে হবে, পায়ে অবশ্যই স্যান্ডেল পরতে হবে, এবং যথাসম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
সমাধানঃ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পরিবারের ছোট বড় সকলেরই কৃমির ওসুধ সেবন করতে হবে।
চর্মরোগঃ
বর্ষাকালে কাঁদা, পানি ও ভেজা পরিবেশে চর্মরোগ দেখা দিতে পারে। যেমন ত্বকে একজিমা,
স্ক্যাবিস, এলার্জি, চুলকানি, খোসপাচড়া ইত্যাদি হতে পারে।
লক্ষণঃ ত্বক চুলকায়, গোটা গোটা ফুসকুড়ি হয়, পাচড়া দৃশ্যমান হয়।
প্রতিকারঃ ভেজা কাপড় বেশীক্ষণ পরে থাকা যাবেনা, শরীরে কাঁদা লাগলে দ্রুত পরিষ্কার করে ফেলতে হবে, কাপড় রোদে বা বাতাসে ভালোকরে শুকাতে হবে, পরিষ্কার কাপড় পরিধান করতে হবে, নোংরা পরিবেশ এড়িয়ে চলতে হবে।
সমাধানঃ এমন হলে সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, প্রয়োজনে গোসলের পানিতে কয়েক ফোটা এন্টিসেপটিক বা নিমপাতা সেদ্ধ করে পানি মিশিয়ে গোসল করতে হবে। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওসুধ সেবন করতে হবে।
এই ছিল বর্ষাকালে সুস্হ থাকার জন্য আজকের স্বাস্থ্য পরামর্শ। ধন্যবাদ ডঃ নুরূল হুদা জনি কে তথ্য এবং পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করার জন্য।
তাঁর পরামর্শ অনুযারী নিজেদের সুস্হ রাখলেই উপভোগ করতে পারবো বর্ষার প্রকৃত সৌন্দর্য।