মাস দুয়েক পরেই রাশিয়ায় বসতে যাচ্ছে ফিফা বিশ্বকাপের ২১ তম আসর। সেই ১৯৩০ সালের প্রথম আসর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিটি বিশ্বকাপেই ব্যবহৃত হয়েছে আলাদা আলাদা বল। ফুটবল ইতিহাসেরই অংশ হয়ে যাওয়া সেই বলগুলো নিয়েই আমাদের প্রিয়লেখার ধারাবাহিক আয়োজন। প্রথম পর্বের পরে আজ দ্বিতীয় পর্বে থাকছে আরও সাতটি আসরের বলের গল্প। সবাইকে পড়ার আমন্ত্রণ।
প্রথমবারের মত কোন প্রধান মডার্ন ব্র্যান্ড বিশ্বকাপের বল প্রস্তুত করে এই বিশ্বকাপে। ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন খুব কঠোরভাবে দেখভাল করে যেন বল বাছাইয়ের সাথে অ্যাসোসিয়েশনের কেউ জড়িত না হয়। জমা হওয়া ১১১ টি বল থেকে লন্ডনে ফিফার কার্যালয়ে বল বাছাই করা হয়।
এর মধ্যে ৪৮ টি বল ন্যূনতম শর্ত পূরণ করতে পারেনি। তালিকা ছোট হয়ে যখন আটে নেমে আসে, তখন আরও দুইটি বল বাদ যায় দীর্ঘমেয়াদে বলের মান ধরে রাখতে না পারার সম্ভাবনার কারণে। শেষ পর্যন্ত বিখ্যাত ক্রীড়াসামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্ল্যাজেঞ্জারের চ্যালেঞ্জ ফোর স্টার বলটি বাছাই করা হয় ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের জন্য। টপস্টারের সাথে অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ এই বলে প্যানেল ছিল ২৫ টি।
বিশ্বকাপ বলের সবচেয়ে যুগান্তকারী পরিবর্তনটা আসে ১৯৭০ মেক্সিকো বিশ্বকাপে। প্রথমবারের মত ফিফা বিশ্বকাপের বল ডিজাইনের দায়িত্ব দেয় অ্যাডিডাসকে। এর আগে ১৯৬৮ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ও মেক্সিকো অলিম্পিকেও বল ডিজাইনের দায়িত্বে ছিল অ্যাডিডাস। বিশ্বকাপের বল ডিজাইন করার কাজেও তাই মেক্সিকো ফুটবল ফেডারেশনকে কাজে লাগায় তারা।
দায়িত্ব পেয়ে অ্যাডিডাস বানায় সাদা-কালো প্যানেলের বল টেলস্টার। প্রথমবারের মত টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয় এই বিশ্বকাপ, দর্শকদের মাঝেও তাই টেলস্টার ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
এটাই যে প্রথম সাদা-কালো ও ৩২ প্যানেলের বল ছিল তা নয়, আবার এর ডিজাইনও একেবারে স্বতন্ত্র ছিল না। ইউরোপে এই ডিজাইনের বল আগে থেকেই বেশ পরিচিত ছিল। তবে ফিফার টেলস্টার বল অনেক পছন্দ হওয়ায় তারা এটিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার প্রকল্প শুরু করে।
টেলস্টার এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, ১৯৭৪ এর পশ্চিম জার্মানি বিশ্বকাপেও আগের বলটাকেই একটু ডিজাইন বদলে ব্যবহার করা হয়, নাম দেয়া হয় টেলস্টার ডারলাস্ট। তবে এই ডারলাস্ট নামটা আগের বিশ্বকাপের বলেও উপস্থিত ছিল। ভেজা আবহাওয়ায় বলের চামড়ার মান ঠিক রাখার জন্যই বলের গায়ে এটি ব্যবহার করা হয়েছিল। এরই মাঝে অ্যাডিডাস ফিফার অফিশিয়াল পার্টনারও হয়ে যায়, ফলে বলে তাদের নিজেদের ব্র্যান্ডিং করার অনুমতিও পায় তারা।
মাঠে যেই বলে খেলা হয়েছে, সেই বলই বিক্রির জন্য অ্যাডিডাসের শো রুমে রাখায় ডারলাস্টের বিক্রি প্রচুর বেড়ে যায়। ওই টুর্নামেন্টে নেদারল্যান্ডস ও ইয়োহান ক্রুইফের জাদুকরী ফুটবলও ডারলাস্টের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ।
১৯৭৮ এর আসর বসে আর্জেন্টিনায়, ডিজাইনার কোম্পানি অ্যাডিডাস তাই স্বাগতিকদের বিখ্যাত নাচ ট্যাঙ্গোর নামেই নামকরণ করে এই আসরের বলের।
যদিও বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই অন্যতম জনপ্রিয় বল হিসেবে স্বীকৃতি পায় ট্যাঙ্গো, কিন্তু অ্যাডিডাস তাদের ডিজাইনকৃত এই বল সম্পর্কে খুব একটা আত্মবিশ্বাসী ছিল না। তাই বিকল্প হিসেবে তারা পর্যাপ্ত পরিমাণ ‘টেলস্টার ১৯৭৮’ বল মজুদ রেখেছিল।
পুরো বিশ্বজুড়েই বিপুল পরিমাণে বিক্রি হয় এই ট্যাঙ্গো, পরিণত হয় অন্যতম জনপ্রিয় ফুটবলে। আরেকটি কারণেও ট্যাঙ্গো আলাদা, এই বল দিয়েই চামড়ার বলের শেষের শুরু হয়।
আগের আসরের বলের জনপ্রিয়তা দেখে স্পেন বিশ্বকাপের জন্য নতুন করে ফর্মুলা তৈরি করতে হয়নি অ্যাডিডাসকে, অনেকটা ট্যাঙ্গোর আদলেই বানায় ট্যাঙ্গো এস্পানা। উন্নতমানের পানি নিরোধক হিসেবে সুনাম কুড়ায় এই বল, পানির হাত থেকে রক্ষার জন্য আলাদা করে ডারলাস্টের আবরণ দিতে হয়নি এই বলে।
বিশ্বকাপের বলের ইতিহাসে অ্যাজটেকা খুব একটা জনপ্রিয় নয়, কিন্তু অন্য কারণে আলাদা হয়ে আছে বলটি।
বিশ্বকাপ ইতিহাসে ব্যবহৃত হওয়া প্রথম সিনথেটিক বল অ্যাজটেকা। পানি নিরোধক ক্ষমতা হোক কিংবা স্থায়িত্ব, সবদিক থেকেই চামড়ার বলের চেয়ে উন্নত ছিল অ্যাজটেকা।
অ্যাডিডাসের একটা অলিখিত নীতি ছিল, আয়োজক দেশের সাথে বলের নামের কোন না কোন সাদৃশ্য রাখা। ব্যতিক্রম হয়নি নব্বইয়ের ইতালি বিশ্বকাপেও। প্রাচীন ইতালির এট্রাস্কানস সভ্যতার নামে নামকরণ করা হয় এই বলের। বলে ইতালীয় শিল্পকলার ছোঁয়াও রাখা হয় খানিকটা। আগের বলের মত এই বলটিও চামড়ার বদলে সিনথেটিক দিয়ে বানানো হয়।