ওদের চারজনের সাথে দেখা হয়েছিলো বসুন্ধরা বারিধারার গেইটের কাছে। প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলায়ই ওদের দেখা মেলে এই জায়গায়। আরো অনেক বন্ধু আছে তাদের এখানে। বয়স ৬ থেকে শুরু করে ১২ বছরের মধ্যেই সবার। দেখা যায় তারা লোকের কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিচ্ছে বা খাবার চেয়ে খাচ্ছে। একরকম জোরাজুরি করেই তারা টাকা বা খাবার আদায় করে। এ জোরাজুরিগুলো অন্যরকম। সহানুভূতি আদায় করার চেষ্টা করে তারা। ভীষণ কচি মুখ প্রত্যেকের। তাই মায়া কাজ করে তাদের জন্য, তাই অনেকেই হয়তো টাকা দেয় বা খাবার কিনে দেয়। তবে এটা যে ভিক্ষা প্রবণতা তারা কি সেটি জানে? এ অন্যায়ের ব্যাপকতা এবং ভবিষ্যৎ কি তারা জানে? তারা ধরেই নেয় এটা তাদের কাজ, খেলা এবং প্রাপ্য। তবে বাস্তবতা তা নয়। এটা তাদের অন্যায়। এ অন্যায়কে এত সহজভাবে নিয়েছে তারা, এর পিছনে নিশ্চই কিছু গল্প আছে। প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা গল্প।
কথা বলেছিলাম শারমিন, সুমাইয়া, আয়েশা ও হৃদয়ের সাথে।
– তোমাদের বাড়ি কই?
শারমিন ও হৃদয়: নতুন বাজার।
– এখানে কখণ আসো?
চারজন: দুপুরে বেলা আহি আর রাইত পর্যন্ত থাহি।
– এখানে কি করো?
সুমাইয়া: মাইনসের দারে টাহা চাই।
– অর্থাৎ ভিক্ষা করো?
( কোন উত্তর নেই)
– টাকা চাও নাকি খাবার চাও?
শারমিন ও হৃদয়: টাকা ও চাই খাবার ও।
– প্রতিদিন কতো টাকা পাও এভাবে?
আয়েশা: জানিনা, টাকা পাইলে খাবার কিন্যা খাই বাড়ি নিয়া যাই, গুণিনা।
– শারমিন তোমার বাবা কি করে?
শারমিন: আমার বাবা রং মিস্ত্রী।
– হৃদয়, তোমার বাবা?
হৃদয়: রিশকা চালায়।
– সুমাইয়া, তোমার বাবা কি করে?
সুমাইয়া: আমার বাবা নাই, মা আছে।
– স্কুলে যাও কেউ?
শারমিন ও হৃদয়: না, যামু।
– পড়াশুনা করতেতো এখন শিশুদের টাকা লাগেনা, তাহলে যাওনা কেন?
হৃদয়: ফি লাগে ফি।
– এই যে লোকের কাছ থেকে টাকা চেয়ে নাও, এটাকি বাসার কেউ শিখিয়ে দেয়?
সুমাইয়া: হয়, আমার মা কয়। কয়, ২০ টাকা নিয়া আহিস। আমরাতো দুইজন, ১০ টাহার চাইল কিন্যা খামু।
– শারমিন, তোমার বাবাতো রংমিস্ত্রী। টাকার অভাব না, তুমি কেন লোকের কাছে টাকা চাও?
(কোন জবাব দেয়না শারমিন)
– হৃদয়, তুমি বিড়ি সিগারেট খাও?
(হৃদয় নিশ্চুপ)
– খায় আফা, অয় বিড়ি খায়।
– কে শেখালো?
হৃদয়: এক বড় ভাই।
– তোমাদের যদি ফি ছাড়া স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়, বইখাতা দেয়া হয়, পড়াশুনা করবা?
ওরা চারজন: করবো আফা করবো।
তাদের সাথে কথা বলে বেশ কিছু বিষয় পরিষ্কার হলো। ওদের এ ভিক্ষাবৃত্তি যে তাদের পারিবারিক আর্থিক অভাবকে ঘোঁচাতে পারে তা নয়, তবু তারা ভিক্ষা করছে। পরিবারের বড়রা তাদের নিষেধ করছেনা বরং অনেক সময় প্রভাবিত করছে। তাদেরকে এই শিক্ষা দেয়ার কেউ নেই যে এটা ভিক্ষা এবং ভিক্ষা অন্যায়। তারা মনে করে এটা তাদের সংস্কৃতি, প্রাপ্য। আর তাই এটাই তাদের চর্চা। হয়তো পরিবারের বড়দেরও তারা এভাবে দেখে অভ্যস্ত। এখানে হৃদয় বিড়ি খাওয়া শিখেছে তার এক বড় ভাইয়ের কাছে। হয়তো সেই বড় ভাইও ভিক্ষা করতে করতে আজ অপরাধ প্রবনতা বা মাদকে আসক্ত। সেক্ষেত্রে এসব শিশুরাও কি কৈশোরে যেয়ে অপরাধী হবে?
তাছাড়া সমাধান বা কোথায়?
ওদের মধ্যে বোধ বা নৈতিকতার ছোঁয়া নেই। সে পরিবেশ তারা পায়না। আর এখন যে চর্চার মধ্যে তারা রয়েছে হয়তো জন্মগত নৈতিকতা যত্নের অভাবে লোপ পাবে। এবং তারা হয়ে উঠবে অপরাধী। অপরপক্ষে শৈশবের প্রয়োজনীয় সময় ভিক্ষা করে কাটানোর পরে এমন এক সময় আসবে তখন অপরাধ বা নোংরা কর্মকান্ড ছাড়া ভিন্ন কোন পথ তাদের জন্য উন্মুক্ত থাকবেনা। কারণ শিক্ষার ছোঁয়া তাদের নেই। এভাবেই একটির পর একটি করে সমষ্টি বড় হচ্ছে আর অপরাধী হয়ে উঠছে। আজ থেকে দু’ বছর পরে হয়তো আজকের হৃদয় শারমিন রা অপরাধী হয়ে উঠবে এবং তাদের ছোট ভাই বোনেরা পরবর্তীতে তাদেরকেই অনুসরণ করবে।
আর এই ধারাবাহিকতায় প্রতি দু’বছর পর একটি করে জনগোষ্ঠী অপরাধী হয়ে উঠলে দেশের ভবিষ্যৎ কোথায় পৌছাবে?
শারমিনদেরও বিয়ে হবে সংসারী হবে।
অশিক্ষিত শারমিনরা জন্ম দেবে অপরিকল্পিত জীবন, আর তাদের ভবিষ্যৎ ও বাবামায়ের মতই হবে।
সুতরাং অধিক হারে বাড়বে জন্মহার, এবং এসব জীবন হয়ে উঠবে অপরাধী। দেশ পৌছবে হুমকীর শিখরে।
তবে, এদেরকেও সম্পদ করে গড়ে তোলা সম্ভব। যারা জানেই না ন্যায় বা অন্যায় কি তাদের কাছে থেকে আমরা কি’ই বা আশা করতে পারি? অপরাধীকে ধরে নিয়ে শাস্তি দিলেই কি অপরাধ কমবে? অপরাধ এবং অপরাধী তৈরী হয় অভাব এবং অচেতনতা থেকে। তাদের আদরে বোঝালে স্কুলে নিয়ে গেলে এবং লেখাপড়ার খরচ বহন করে নূন্যতম মূল্যবোধের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারলে, তারা বুঝবে ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য। আর এ দায়িত্ব সমাজের শিক্ষিত মহলের, সরকারের। সম্পূর্ণ ঢাকা শহরজুড়েই এধরণের পথশিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় স্কুলের ব্যবস্হা রয়েছে। প্রয়োজন শুধু এদেরকে স্কুল পর্যন্ত নিয়ে আসা এবং এরা যেন মাঝপথে ঝরে না পড়ে সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া। কিছু বছর এভাবে পড়াশোনা করাতে পারলে একদিন এরাই সাবলম্বী হবে এবং পরবর্তীতে তাদের উত্তরাধিকারীদের তারা ভালো পথে চালিত করবে।
এভাবে বাঁচবে শিশু, বাচবে জীবন, বাঁচবে দেশ, প্রকারান্তরে অর্থনীতি এবং সার্বিক ভবিষ্যৎ। অপরাধীর জন্য শাস্তির ব্যবস্হা নেয়ার আগে অপরাধী উৎপন্ন হওয়ার পথ বন্ধ করাই কার্যকরী।
ছবিঃ সংগৃহীত