বর্তমান বলিউডে তাঁর মতো দক্ষ অভিনেতা খুব কমই আছেন। নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে মন জয় করে নিয়েছেন অসংখ্য ভক্ত-সমর্থকের। কিন্তু আজকের এই জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছানোর পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর। সেই গল্পই আজ শোনাবো, নওয়াজের নিজের মুখেই।
নওয়াজ: আমার ব্যক্তিত্ব এতটাই সাধারণ, আমি খুব সহজেই মানুষের সাথে মিশে যেতে পারি। বলিউড হিরোদের যেই গতানুগতিক ইমেজ, তার সাথে আমার ইমেজ খুব একটা যায় না। সুন্দর চেহারাও নেই, পেশীবহুল শরীরও নেই। এটা বরং একটা সুবিধা, এর কারণেই আমি রাস্তাঘাটে নিজের মতো ঘুরে বেড়াতে পারি। যতক্ষণে লোকে খেয়াল করে, ততক্ষণে আমি গায়েব!
নওয়াজ: আমি কৃষক পরিবারের সন্তান। উত্তর প্রদেশের মুজাফফারনগর জেলার বুধানা গ্রামে আমার জন্ম-কর্ম সব। শিক্ষার জন্য খুব বেশি সুযোগ ছিল না সেখানে। কিন্তু যেকোনোভাবেই হোক আমি ও আমার ভাই-বোনেরা পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমাদের গ্রামে কেবল তিনটাই জিনিস চলে- গম, আঁখ আর বন্দুক। এই বন্দুকভীতির কারণেই আমাদের গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল।
থিয়েটারের প্রতি আমার আগ্রহটা আরও অনেক পরে জন্মায়। পড়াশোনা শেষ করার পর বরোদায় চিফ কেমিস্টের কাজ করেছি। এরপর দিল্লীতে এক থিয়েটার গ্রুপে যোগ দেই। থিয়েটার করে যেহেতু কোন আয় রোজগার হতো না, পেট চালানোর জন্য তাই আমাকে ওয়াচম্যানের কাজ করতে হতো। দুটোই একইসাথে চালাতাম তখন। এরপর ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা (এনএসডি) তে ভর্তি হই, সেখান থেকে পাশ করে বের হই ১৯৯৬ সালে। দিল্লীতে চার বছর কাজ করার পর ২০০০ সালে মুম্বাই এসে পৌঁছাই।
নওয়াজ: দিল্লীতে আমার টাকা পয়সা বেশিরভাগই ফুরিয়ে গিয়েছিল। শুরুতে ভেবেছিলাম মুম্বাইতে কাজ পাওয়া সহজ হবে। কিন্তু ভাবনা ভাবনাই রয়ে গেলো। ৪-৫ বছর ধরে অনেক ছোট ছোট চরিত্র করেছি, জনতার মধ্যে মিশে থাকা চরিত্রও করেছি। ওই সময়টায় বলিউড সিনেমা একটা নতুন শেপ নিচ্ছিল। অনুরাগ কাশ্যপের মতো পরিচালকেরা ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’র মতো সিনেমা বানানো শুরু করলেন। আস্তে আস্তে কাজ পাওয়া শুরু করলাম। গত ৩-৪ বছরে প্রায় ১০ টির মতো সিনেমা করেছি, যেখানে আমাকে কেন্দ্রীয় না হয় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র দেয়া হয়েছে।
নওয়াজ: আমার বাবা-মা এমন এক গ্রামে থাকেন, যেখানে কোন থিয়েটার নেই। সিনেমা দেখানো হয় মুজাফফরনগরে, আমাদের গ্রাম থেকে যার দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। আমাকে দেখার জন্য তারা অতটা রাস্তা ছুটে যান। তারা আমার কাজ নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলে না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি কোন কাজ করছি, এবং নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে করছি, তাদের কোন আপত্তি নেই।
নওয়াজ: আমার নিজের কাছে এক ধরনের তৃপ্তি লাগে, কারণ আমি সবাইকে ভুল প্রমাণ করতে পেরেছি। সবাই বলেছিল, ‘এ কীভাবে হিরো হবে?’ এখন যখন বাড়ি যাই, সবাই বলে, ‘এ তো হিরো হয়েই দেখিয়েছে!’ আমি এটা সম্ভব করতে পেরেছি।
নওয়াজ: হ্যাঁ! ভালোভাবেই যুক্ত।
নওয়াজ: বলেছি তো। ওরা এসেছিলও। কিন্তু গ্রামের খোলা পরিবেশে সারা জীবন কাটিয়েছে তো, শহরে ওদের দম বন্ধ হয়ে আসে (হাসি)। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাই গ্রামে, ওদের মনও ওখানেই পড়ে থাকে…
নওয়াজ: অনেকবার মনে হয়েছে, আমি এখানে আমার সময় নষ্ট করছি। কারণ কোন কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। কিন্তু আমি ফিরেও যাইনি। ওখানে গিয়েই বা কি করতাম? সারা জীবন অভিনয়ের পেছনে দিয়েছি, আর কোন কাজ তো আমি পারিই না! এছাড়া বন্ধুরা কথা শোনাবে, সেই চিন্তাও ছিল। বলতো, ‘হিরো হতে গিয়েছিল, জিরো হয়ে ফিরে এসেছে।’
নওয়াজ: এটা এমন একটা গ্রাম, যেখানে কোন আইন নেই। এমনকি পুলিশও ওখানে হস্তক্ষেপ করতে ভয় পায়। সামনে থেকে দেখার বহু অভিজ্ঞতা হয়েছে। শেষবার যখন বাড়ি গেলাম, ছয় দিনে সাতটা খুন হয়েছে! খুন ব্যাপারটা পুরো গ্রামে যেন ডালভাত হয়ে গেছে, কেউ আর ভ্রুক্ষেপই করে না এখন। পুলিশও অসহায়। এই গ্রামে কোন আইন নেই, কোন সরকার নেই।
নওয়াজ: এই যে আপনিই তো দেখলেন, শেষ ২০ মিনিটে আটটা ফোন ধরতে হলো আমাকে। লোকজন আমার কাজের প্রশংসা করতে ফোন দিচ্ছে, মেসেজ পাঠাচ্ছে। ভালো লাগে।
নওয়াজ: না খুব একটা না, কারণ আমি জানি ওরা আমার কাজ নিয়েই কথা বলছে। তবে সমস্যাটা হয় যখন শুটিংয়ের মাঝে এসব ফোন আসে, কারণ এতে আমার কাজে প্রভাব পড়তে পারে। আমি চাই না আমার মনোযোগ কাজের থেকে বিন্দুমাত্র সরে যাক। আমি এগুলোকে কাজের অংশ হিসেবেই দেখি, এটা তো মেনে নিতেই হবে।
নওয়াজ: না না, ঠিক তা না। ‘পিপলি লাইভে’ সাংবাদিক রাকেশের চরিত্র করেছি, ‘দেখ ইন্ডিয়া সার্কাসে’ জেঠুর চরিত্র করেছি। হ্যাঁ তবে এটা সত্য যে আমি কিছু মুসলিম চরিত্রও করেছি।
নওয়াজ: সাসপেন্স থ্রিলার ভিত্তিক ছবিটিতে আমি বেশ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিলাম। আমির খান এমন একজন সুপারস্টার যে কিনা ‘লগান’, ‘পিপলি লাইভ’, ‘তারে জামিন পার’, ‘দিল্লী বেলি’র মতো সিনেমা করতে পারেন। আমার দৃষ্টিতে তিনি একজন অভিনেতা যে কিনা প্রচণ্ড পরিশ্রম করে, আর সব ধরনের ছবিতেই টাকা খাটায়। আমির যেভাবে আমাকে সম্মান দেখিয়েছে, আমি এক কথায় অভিভূত।
নওয়াজ: ইন্ডাস্ট্রিতে আসা প্রত্যেক তরুণ পরিচালকের সাথে কাজ করতে চাই আমি। এই নতুনদের নিজস্ব চিন্তাধারা থাকে, কাজ করার নিজস্ব একটা ধরন থাকে। পরিচালকেরা যেভাবে একজন অভিনেতার প্যাশন ও এনার্জি শুষে নেয়, আমিও তেমন তাদের প্যাশন ও এনার্জি শুষে নিতে চাই।
নওয়াজ: এমনও হয়েছে, চরিত্রের জন্য আমাকে চূড়ান্ত করা হয়ে গিয়েছে, পরে ডেকে বলা হয়েছে চরিত্রটি আমি করছি না। প্রত্যাখ্যানের সাথে বেশ ভালো রকম বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল আমার। একটা নির্দিষ্ট সময় পরে এটা আর কোন প্রভাব ফেলতো না আমার উপর।
নওয়াজ: হুমা আর আমার একটা রোমান্টিক দৃশ্যে অভিনয় করার কথা। যেখানে আমরা একে অপরের দিকে চশমার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে থাকবো। তো হুমা আমাকে বললো, ‘নওয়াজ ভাই, আমি আপনার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপব।’ চিন্তা করুন অবস্থাটা, রোমান্টিক দৃশ্যের শুটিংয়ের আগে আমাকে ভাই ডাকছে! আমি অনুরাগের কাছে বিষয়টা বললাম। পরে অনুরাগ হুমাকে বলে দিয়েছিল, রোমান্টিক দৃশ্যের আগে নওয়াজকে ভাই ডেকো না (হাসি)।