ছাদের ওপর শুয়ে আছে দেহটা। নিথর, স্পন্দনহীন। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের বুনো উল্লাস, অস্ত্র উঁচিয়ে তাকে ঘিরে চলছে ফটোসেশন। এরই মাঝে কিছু মাছি এসে ভন ভন করছে। চারপাশে রক্ত ছিটিয়ে আছে এদিক ওদিক। কলাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হতে চাওয়া মানুষটি জিভ উলটে নিথর শুয়ে আছে খোলা নগ্ন আকাশের নিচে। মাছিগুলো মুখ ব্যাদান করে তাকেই উপহাস করছে কি? কে জানে! তবে, অবশেষে! অবশেষে এতোদিনে তাহলে শেষ হল কুখ্যাত কলাম্বিয়ান ড্রাগ লর্ড পাবলো এমিলিও এসকোবার গাভিরিয়ার একটি কালো অধ্যায়।
নেটফ্লিক্সে যারা “নারকোস” নামক সিরিয়ালটি দেখেছেন কিংবা ড্রাগলর্ডদের ইতিবৃত্তান্ত সম্পর্কে শখের বশে হলেও কিছুটা পড়াশোনা করেছেন, তাদের কাছে পাবলোর নামটি এতোদিনে পরিচিত হয়েই গিয়েছে। ম্যাডেইনের প্রান্তরে বড় হওয়া সে শিশুটির অধ্যায় সমাপ্ত হয় ম্যাডেইনেরই একটি পাকা দালানের ছাদের ওপর।
১৯৪৯ সালের পহেলা ডিসেম্বর কলাম্বিয়ার রিওনিগ্রোতে জন্ম হয় এসকোবারের। তিনভাই ও তিনবোনের বড় আদরের ছিলেন এসকোবার। কিন্তু খুব দ্রুতই হাসিখুশি এই পরিবারের দৃশ্যপটটি বদলে যেতে শুরু করে। ম্যাডেইনের আকাশে আবির্ভূত হয় নতুন একটি সত্ত্বা। এই সত্ত্বাটি ছড়িয়ে পরতে শুরু করে প্রতিটি ঘরে, আতংক ছড়াতে শুরু করে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মনে। ব্যক্তিটি কে? এই এসকোবার। তার মৃত্যু নিয়ে নানা কথা রয়েছে। আদতেই কি তিনি কলাম্বিয়ান পুলিশদের হাতে নিহত হয়েছিলেন, নাকি পরিবারের স্বার্থে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, তা নিয়ে হচ্ছে নানা ধরণের প্রশ্ন। নানা সন্দেহের বীজ বোনা ইতোমধ্যেই শুরু করেছেন তার ভাই ও ছেলে। তবে তার আগে আসুন কিছু শুরুর কথা জেনে নেয়া যাকঃ
সপ্তাহে প্রায় ৪২০ মিলিয়ন ডলার আয় হত পাবলো এসকোবার কার্তেলের। আর হবেই বা না কেন? যুক্তরাষ্ট্রে যেসব কোকেইন জলপথে চালান হত, তার ৮০ শতাংশই যে নিয়ন্ত্রণ করত সে! ১৯৭০ এর দশকের একদম প্রথম থেকে ড্রাগ কার্টেলের সাথে যুক্ত হয় পাবলো। তার সাথে যোগ দেয় ম্যাডেইনের ছোট বড় আরো কিছু অপরাধীরা। গড়ে তোলে বিশাল বড় একটি ড্রাগ কার্টেল। ফোর্বসের মতে, তৎকালীন সময়ের পৃথিবীর সেরা ১০ জন ধনকুবেরদের মাঝে একজন ছিলেন পাবলো। নানা ধরণের দাতব্য কাজ, ফুটবল ক্লাব গড়ে তোলা ইত্যাদি জনসেবামূলক ও জনপ্রিয় কাজের মাধ্যমে ম্যাডেইনের মানুষের মনে খুব দ্রুত জায়গা শুরু করে নিতে শুরু করেছিলেন এসকোবার। কোন কোন সময় দেখা যেত, পাবলোর খোঁজে পুলিশ এলে রাস্তা পর্যন্ত ব্লক করে রাখতো ম্যাডেইনের মানুষ। এমনকি শিশুরা পর্যন্ত বিনা দ্বিধায় তার জন্য ইনফর্মারের কাজ করতে কুণ্ঠাবোধ করত না। বস্তা বস্তা টাকা আর ভালো ভালো কথার মাধ্যমে পাবলো খুব দ্রুতই তাদের মনে স্থায়ী একজন রবিন হুড হিসেবে নিজেকে চেনাতে শুরু করেন। তবে খুব বেশি দিনের জন্য নয়। যত্রতত্র হত্যা এবং অকারণেই রক্তপাতের কারণে জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করেন পাবলো। এর সাথে সাথে কলাম্বিয়ান পুলিশের তৎপরতা তো ছিলই।
১৯৮০ এর মাঝামাঝি সময়ে পাবলোর ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ এসে দাঁড়ায় প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারে। বলা হত যে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৫ টন কোকেইন স্মাগল করা হত প্রতিদিন; যার ৮০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করত এসকোবার। এসকোবারের বাড়ি, হাসিয়েন্দা নাপোলি, ছিল তৎকালীন সময়ে পৃথিবীর অভেদ্য দূর্গগুলোর মাঝে একটি। তবে এই দূর্গতেও বেশ কয়েকবারই হামলার শিকার হন এসকোবার। ১৯৯৩ সালের ২রা ডিসেম্বর অবশেষে “চ্যাপ্টার ক্লোজড” হয় পাবলো এসকোবারের। ঠিক এই জায়গাটিতেই কিছু প্রশ্ন জনসম্মুখে নিয়ে আসেন তার পুত্র সেবাস্টিয়ান ম্যারোকুইন। কে এই ম্যারোকুইন?
হুয়ান পাবলো এসকোবার নাম পরিবর্তন করে পাবলো এসকোবারের পুত্র রাতারাতি বনে যান সেবাস্টিয়ান। একইসাথে তিনি হয়ে ওঠেন একজন মোটিভেশনাল স্পিকার। তিনি বলছেন, নেটফ্লিক্সে দেখানো সিরিয়ালটিতে তার বাবাকে পোট্রে করা হয়েছে অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে এবং অনেক ক্ষেত্রে রঙ চড়ানো হয়েছে। পাবলো এসকোবার মোটেও তা ছিলেন না। এমনকি তাদের পরিবার নিয়েও বেশ কিছু বাড়তি কথা বলা হয়েছে, যা একটি বায়োগ্রাফিকাল টিভি সিরিজে লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে মিথ্যে ও নগ্নভাবে পরিবেশন করা হয়েছে। সেবাস্টিয়ানের দাবি-
১) পাবলোকে দেখানো হয়েছে তিনি ফুটবল খেলার প্রতি বিশেষ অনুরক্ত। তবে তিনি অ্যাটলেটিকো ন্যাশিওনালের নয়, বরং ডেপোর্টিভো ইন্ডিপেনদিয়েন্তে ম্যাডেইনের ভক্ত ছিলেন। এমন একটি ফ্যাক্ট যদি নেটফ্লিক্স কর্তৃপক্ষ ভুল করে তাহলে কিভাবে পুরো সিরিজটির ওপর মানুষ বিশ্বাস করবে?
২) ১৯৯২ সালে লা ক্যাট্রেডাল থেকে এসকোবারের পালাবার সময় লা কুইচা নিউ ইয়র্কে পরিচয় জাল করার অপরাধে জেলে ছিলেন। আভিয়াঙ্কা বিমানে বোমা হামলার জন্য তাকে অকারণে দোষারোপ করা হয়েছে এবং সিরিজে বাজেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এসকোবার এটিও দাবি করতেন যে ১৯৮৯ সালের হামলাগুলো কার্লোস কাস্তানোর নির্দেশে ঘটেছিল।
৩) লা ক্যাট্রেডাল থেকে পালাবার সময় এসকোবারের সাথে কোন বড় ধরণের রক্তপাতের সংগঠিত হয় নি কলাম্বিয়ান পুলিশের। শুধুমাত্র একজন গার্ড নিহত হয়েছিল। জেল প্রতিস্থাপন চুক্তি থেকে সরকারের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসতে বাধ্য হবার কারণে জেলের সেল থেকে ইট সরিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন এসকোবার।
৪) সিরিজের দ্বিতীয় সিজনে আমরা দেখতে পাই লিমনকে, যে পাবলোর ড্রাইভার হিসেবে কাজ করত। সেবাস্টিয়ান বলছেন, এই লিমন আরো পুরোনো লোক। পাবলো এসকোবারের বড় ভাই, রবার্তো অসিতোর জন্য ২০ বছর আগে কাজ করত লিমন। তাহলে সিরিজে লিমনের বয়সের সাথে প্রকৃত লিমনের বয়সের বেশ বড় ধরণের একটি গোলমাল দেখা যায়। তাছাড়া, এসকোবারের শোফার আদতেই লিমন ছিলেন কি না, সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে সেবাস্টিয়ানের।
৫) ড্রাগের ছড়াছড়ি ও ডিমান্ড এত বেশি ছিল যে, কালি কার্টেল ও এসকোবার কোন ধরণের চুক্তিতে এসেছে এটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা রীতিমত হাস্যকর। কারণ, কাঁচা তাকার চাইতেও তখন ড্রাগের পরিমাণ ও সরবরাহ অস্বাভাবিক পরিমাণের বেশি ছিল।
৬) ১৯৮০ এর দশকে পাবলোর হাতে প্রায় ৫০০’এরও অধিক পুলিশ সদস্য নিহত হন। তবে সেবাস্টিয়ানের দাবি, কর্নেল কারিহো ব্যক্তিগতভাবে খুন করেন নি এসকোবার। সেবাস্টিয়ান তার বাবার এহেন কৃতকর্মের জন্য পরবর্তীতে অনেক ক্ষমা চেয়েছেন তবে কর্নেল কারিহোকে এসকোবারের খুন করার কথা তিনি অস্বীকার করেছেন।
৭) কালি কার্টেলকে এসকোবার কখনো কোন ধরণের হুমকি দেন নি। তিনি সরাসরি তাদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
৮) সেবাস্টিয়ানের মা, অর্থাৎ পাবলোর স্ত্রী কখনো বন্দুক হাতে নেন নি।
৯) লা ক্যাট্রেডাল থেকে পালাবার পর কলাম্বিয়ান ড্রাগ লর্ডের দিন কাটে হোভেলগুলোতে (আবাসিক সস্তা হোটেল)। বিলাসবহুল ম্যানশনে তিনি ফেরত আসেন নি।
১০) এবার আসা যাক, এসকোবারের মৃত্যু প্রসঙ্গে। সেবাস্টিয়ান বার বার করে বলছেন, কোন কলাম্বিয়ান পুলিশ সদস্য কিংবা আমেরিকান পুলিশ বাহিনীর হাতে নয়, বরং এসকোবার পরিবারের স্বার্থের জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। Pablo Escobar: My Father নামক বইতে সেবাস্টিয়ান বলেছেন তার বাবা তাকে প্রায়ই বলতেন, কোন সময় তার জীবন যদি হুমকির মুখে পরে, তাহলে এসকোবার নিজের হাতে নিজের জীবন নিয়ে নেবেন। সেখানে সেবাস্টিয়ান আরো বলেন তৎকালীন কমিউনিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমেরিকান সরকার কলাম্বিয়া ও এর ড্রাগ লর্ডদের কিভাবে হাতের পুতুল হিসেবে ব্যবহার করেছে, প্ল্যান্ট করেছে আমেরিকান সৈন্যদের কলাম্বিয়ার মাটিতে। এমনকি সেবাস্টিয়ান দাবি করেন, সিরিজে দেখানো মৃত্যুদৃশ্যের ছবিগুলো ফটোশপড এবং করোনারকে জোর করা হয়েছিল মিথ্যা রিপোর্ট দেয়ার জন্য। তিনি আরো বলেন, সেদিন ছাদের ওপর এসকোবার নয়, তার একজন গার্ড নিহত হয়েছিলেন। ফটোশপ করে তাকে এসকোবারের সাথে বডি ম্যাচিং করা হয়েছে।
পাবলো এসকোবার এমনই একটি চরিত্র, যাকে নিয়ে সারাদিন কথা বললেও বোধহয় যুক্তিতর্ক আর বিতর্কের অবসান হবে না। তবে একথা ঠিক, আজকের কলাম্বিয়াতে ড্রাগ কার্টেলের যে দৌরাত্ম্য, তাতে পাবলোর অবদান অসীম। এ সত্ত্বেও পাবলোকে নিয়ে নানা মিশ্র প্রতিক্রিয়াও কিন্তু রয়েছে। কেউ কেউ তাকে এখনো রবিন হুড বলেও জানে। হয়ত ম্যাডেইনের অশীতিপর একজন বৃদ্ধ পানশালায় বসে তার ড্রিংকে চুমুক দিতে দিতে এখনো ফুঁৎকারে সব উড়িয়ে দিয়ে বলে, “সব ডাহা মিথ্যে। পাবলো তো আমাদের রবিন হুড!”
আজ এ পর্যন্তই। প্রিয়লেখার সাথেই থাকুন।
(তথ্যসূত্রঃ দ্য টেলিগ্রাফ, বায়োগ্রাফি ডট কম, দ্য সান, সেলেবফ্যামিলি, এক্সপ্যাটনেশন)