সাহিত্যে প্রায়শ আমরা এমন কিছু সভ্যতার উল্লেখ পাই, বর্তমানে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। এই হারিয়ে যাওয়া নগরীগুলোর মধ্যে বেশ নামকরা ও উল্লেখযোগ্য একটি শহর। ইতিহাসের ছেঁড়া পাতায় মুড়ে, কালের অতল গহ্বরে কোথায়, কখন তা হারিয়ে গেছে কেউ তা জানে না।
শুরুতেই বলে নেয়া ভালো এটি কোনো ধর্মীয় পোস্ট নয়, ধর্মীয় কোনো বিতর্ক এখানে উসকে দেয়া হচ্ছে না। তবে পবিত্র কোরআনে এই শহরটির কথা বলা হয়েছে বিধায়, এখানে শুধু রেফারেন্স হিসেবে কোরআনের নাম উল্লেখ করা হবে। এই শহরটির আদৌ কোনো অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়ে মুসলিমদের মধ্যেও নানা ধরনের বিতর্ক প্রচলিত আছে। ইরাম অফ দ্য পিলারসকে অনেকে আরাম, এরাম বা ইরেম নামে ডাকেন।
ইরাম অফ দ্য পিলারস সম্পর্কে সুন্দর বর্ণনা দেয়া হয়েছে সুরা আল ফজরে। এখান থেকেই অবশ্য এ নিয়ে হাজারো বিতর্কের উৎপত্তি ঘটেছে। সুরাটির আয়াত ৬, ৭ এবং ৮ এ মহান আল্লাহতায়ালা বেশ সুস্পষ্টভাবে এই শহরটির একটি বর্ণনা দিয়েছেন। ৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন আদ জাতির কথা। এখানে তিনি মানুষকে আদ জাতির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন। তিনি এখানে সমগ্র আদকে সামষ্টিকভাবে তাদের নাম ধরে সম্বোধন করেছেন। অর্থাৎ তিনি এই সংশয় দুর করে দিয়েছেন যে তিনি কোন মানুষকে সম্বোধন করেননি, তিনি সরাসরি একটা জাতিকে সম্বোধন করেছেন। এর মানে হচ্ছে এর পরে তিনি যা বলবেন তা ঐ সমগ্র জাতির বিষয়ে বলবেন, কারো ব্যাক্তিগত বিষয়ে না।
এর পরের আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন ইরাম নামক শহরটির কথা। এই শহরে অনেক পিলার বা কলাম ছিল আর তাদের দৈর্ঘ্য অনেক বেশি ছিল। এই স্থানে অনেক অনুবাদক এবং তাফসিরকারক বেশ ভালো বিতর্ক করে ফেলেছেন। তারা আগের আয়াতের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ধরে নিয়েছেন, এখানে আদ জাতির শারীরিক গঠন সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। কিন্ত আসলে এখানে ওই শহরের কাঠামো এবং প্রকৌশল সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা অল্প কয়েকটি শব্দে বেশ বড় একটি ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।
তিনি বলেছেন ইরাম শহরে লম্বা লম্বা সব পিলার ছিলো। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, মরুভূমির মধ্যে পিলার তৈরি করার কী দরকার পড়লো আরবদের? আর সেই পিলারগুলো এত লম্বা করার পিছনেই বা কারণ কী? এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিংশ শতাব্দিতে বেশ কয়েকটি আর্কিওলজিক্যাল এক্সপিডিশন বা প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯২ সালের অভিযানটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন। দলটি স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে এ ধরনের একটি শহরের অস্তিত্ব সম্পর্কে বেশ খানিকটা নিশ্চিত হয়েছিলেন।
পরের আয়াতে আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন, এই ধরনের কোন কিছু এই ভূমিতে দ্বিতীয়বার তৈরি করা হয়নি। এর মানে হচ্ছে যখন এই আয়াত যখন নাজিল হয় তখন এই ধরনের কোন কাঠামোর কোনো অস্তিত্ব পৃথিবীর বুকে ছিল না। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি এই শহরটি প্রকৌশল এবং প্রত্নতাত্ত্বিক দিক দিয়ে একটা অত্যাশ্চর্য ছিলো। নিজেদের সৃষ্টিকর্মে বিমোহিত হয়ে এখানকার মানুষরা সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে গিয়েছিল। পিলারগুলোর এই অসাধারণ শক্তিমত্তার কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা এগুলোকে নিয়মিত পূজা করতে শুরু করে।
ইরাম নগরীকে কেন মরুভূমির আটলান্টিস বলা হয় সে সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পাওয়া যায় কোরআন থেকেই। বলা হয়, পথভ্রষ্ট আদ জাতিকে সুপথে পরিচালিত করতে আল্লাহ্ তায়ালা হযরত হুদকে (আঃ) ইরাম নগরে প্রেরণ করেন। কিন্তু তারা নিজেদের জ্ঞান-প্রজ্ঞা আর প্রভাব-প্রতিপত্তির মোহে এতোটাই অন্ধ ছিল যে, আল্লাহ্র এই নবীকেও তারা মান্য করেনি। তাদের নির্মাণ করা পিলারগুলোর ভিত এতোটাই শক্ত ছিল যে তা মরুভূমির বিপুল পরিমাণ বালির পাহাড়ের সাথে যুদ্ধ করে টিকে গিয়েছে। মূলত এই জন্যই এই পিলারগুলো এতটা গুরুত্বপূর্ন এবং এগুলো নিয়ে সবসময় কথা হয়েছে।
ধারনা করা হয়, শহরটির এত সম্পদের প্রধান কারণ হচ্ছে এই অঞ্চল দিয়ে ব্যবসায়িরা যাতায়াত করতেন পুরো আরব অঞ্চলে। আর এই অঞ্চলটা ছিল তাদের একটি ক্রসপয়েন্ট, অনেকটা চৌরাস্তার মতন। তাই এখানে প্রচুর হোটেল ছিল এবং সেখানে সম্ভবত ব্যাপকমাত্রায় পতিতাবৃত্তি চালু ছিল। এই অঞ্চলের মানুষের সম্পদের প্রধান একটি উৎসও ছিল দেহ ব্যবসা। এই কারণেই এই শহরকে মরুভূমির আটলান্টিস বলা হতো। এখানে পুরো আরবের মানুষেরা আমোদ-ফুর্তি করার জন্য আসতো এবং প্রচুর টাকা উড়াত। আল্লাহ্পাকের আদেশ অমান্য করায় এবং তাঁর নবীকে ছোট করে দেখায় আদ জাতির উপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হন তিনি। যার কারণে আট দিন সাত রাত ব্যাপী সেখানে চলে মরুঝড়।
যে আদ জাতি তাদের সুউচ্চ পিলারের গর্বে সৃষ্টিকর্তাকে পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিল, তাদের সেই পিলারগুলো এই ঝড়ে মাটির সাথে পুরোপুরি মিশে যায় আর নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় গোটা আদ জাতি। পিলারগুলোকে তাই অনেকে ‘শয়তানের খাম্বা’ বলে ডাকেন। ৯০ দশকের শুরুর দিকে নিকোলাস ক্লাপ নামের এক প্রত্নতাত্ত্বিক উবার নামক একটি শহরের সন্ধান পান। শহরটির যাবতীয় বর্ণনা হুবুহু ইরাম শহরের সাথে মিলে যায়। উবার আর ইরাম শহর একই কিনা তা নিয়ে এখনো হাজারো বিতর্ক চালু আছে, ইরাম শহরের উপস্থিতি আদৌ ছিল নাকি এটি শুধুই একটি নীতিকথা মূলক গল্প তা নিয়েও সংশয় আছে। আরবের মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা এই রহস্যের কোনো কূলকিনারা পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে ইতিহাসবেত্তারাও নিশ্চিত নন।