সৌরজগতের সপ্তম গ্রহ, ইউরেনাস সম্পর্কে আমাদের অনেকের প্রাথমিক জ্ঞান হয়তো এটুকুই। কিন্তু এই ইউরেনাস নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই বিজ্ঞানীদের। সৌরজগতের বাকি গ্রহগুলোর বেশিরভাগের চেয়েই যে এটি অনেকাংশেই আলাদা। টেলিস্কোপ দিয়ে আবিষ্কৃত প্রথম গ্রহ এটি, সৌরজগতের দুইটি ‘আইস জায়ান্টের’ মধ্যে নিকটতমও। প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ইউরেনাসে পদার্পণ করেনি বিজ্ঞানীরা, সেখানকার অভ্যন্তরীণ গঠন ও পরিবর্তন সম্পর্কে তাই বিজ্ঞানীদের আগ্রহের অন্ত নেই। তারপরেও অনেক গবেষণা করে ইউরেনাস সম্পর্কে বিস্ময়কর কিছু তথ্য আবিষ্কার করেছে তারা।
দূরত্বের দিক থেকে ইউরেনাস সূর্য থেকে সপ্তম গ্রহ, আয়তনে চতুর্থ বৃহত্তম, ঘনত্বের দিক থেকেও সপ্তম। সূর্য থেকে পৃথিবী ৯৩ মিলিয়ন মাইল দূরে, আর ইউরেনাস ১৭৮৪ মিলিয়ন মাইল দূরত্বে। প্রস্থের দিক থেকে ইউরেনাস পৃথিবীর চেয়ে চার গুণ বেশি। ইউরেনাসে এখনো পর্যন্ত ২৭ টি চাঁদের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে, আর সবকয়টি চাঁদের নামকরণ করা হয়েছে উইলিয়াম শেক্সপীয়ার ও আলেক্সান্ডার পোপের সাহিত্য চরিত্রের নামে। ইউরেনাসের বহিঃপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কত জানেন? মাইনাস ৩৫৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট! ইউরেনাসে এক বছর সময় পৃথিবীর ৮৪ বছর সময়ের সমান! অর্থাৎ পৃথিবীতে জতদিনে ৮৪ বছর শেষ হয়, ইউরেনাসে ততদিনে মাত্র ১ বছর শেষ হয়।
বেশিরভাগ গ্রহই সৌরজগতে সূর্যকে লম্বভাবে প্রদক্ষিণ করে। কোনটা হয়তো আস্তে প্রদক্ষিণ করে, আবার কোনটা জোরে, কিন্তু লম্বভাবেই করে। এদিক থেকে ইউরেনাস ভিন্ন। ফ্লোরে বল যেভাবে গড়িয়ে চলে, ইউরেনাসের সূর্যকে প্রদক্ষিণ করাও অনেকটা সেরকমভাবে। অর্থাৎ, গ্রহটির প্রত্যেক গোলার্ধের দিন থেকে রাতে পৌঁছাতে অর্ধেক কক্ষপথ পরিভ্রমণ করতে হয়, পৃথিবীর মত পুরো কক্ষপথ পরিভ্রমণ করতে হয় না। পৃথিবীর সাথে আরেকটা বড় পার্থক্যও আছে ইউরেনাসের। পৃথিবী নিজের কক্ষপথে সূর্যকে কেন্দ্র করে পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘোরে, কিন্তু ইউরেনাস ঘোরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। ইউরেনাসের মত শুক্র গ্রহও পূর্ব থেকে পশ্চিমে ঘোরে।
একটু খেয়াল করে দেখেছেন কিনা কখনো, পৃথিবী বাদে সৌরজগতের বাকি গ্রহগুলোর নামকরণ করা হয়েছে রোমান দেবতাদের নামে। পৃথিবী এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, কারণ পৃথিবী আবিষ্কারের সময় বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত ছিলেন না পৃথিবী আদৌ কোন গ্রহ কিনা, তাই পৃথিবীর নাম রোমান দেবতার নামে রাখা হয়নি তখন। পৃথিবী ছাড়া আর ব্যতিক্রম আছে একটিই, সেটি হল ইউরেনাস। রোমান মিথোলজি অনুযায়ী, মার্স (মঙ্গল) হল জুপিটারের (বৃহস্পতি) ছেলে, আবার জুপিটার হল স্যাটার্ন (শনি)র ছেলে। গ্রীক মিথোলজির অউরানোসের সমকক্ষ রোমান মিথোলজিতে কেউ নেই, আর ল্যাটিন সাহিত্যে এই অউরানোস পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউরেনাস। আর সেখান থেকেই ইউরেনাস গ্রহের নামকরণ।
সৌরজগতের গ্রহগুলোর মধ্যে দুইটি ‘আইস জায়ান্ট’ আছে, ইউরেনাস আর নেপচুন। ‘আইস জায়ান্ট’ মানেই যে এরা বিশাল বিশাল বরফখণ্ডে ভর্তি, তা কিন্তু নয়। তাদের গঠনের কারণেই এমন নামকরণ করা হয়েছে। বৃহস্পতি, শনি এসব গ্রহের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস দ্বারা পরিপূর্ণ, তাই এদের বলা হয় ‘গ্যাস জায়ান্ট’। পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগ পরিপূর্ণ সিলিকেট ও আয়রন দিয়ে। কিন্তু ইউরেনাস ও নেপচুনের ক্ষেত্রে এই অভ্যন্তরভাগ পূর্ণ পানি, মিথেন ও অ্যামোনিয়া দ্বারা, অবস্থাভেদে এরা গ্যাস হিসেবেও থাকতে পারে, কিংবা বরফ হিসেবেও থাকতে পারে। ‘ভয়েজার-২’ এর অভিযানের পর এসব তথ্য আবিষ্কৃত হওয়ায় বিজ্ঞানীরা এই দুটি গ্রহকে নাম দিয়েছেন ‘আইস জায়ান্ট’।
সব গ্রহই গরম। ছোট গ্রহগুলো সময়ের সাথে সাথে নিজেদের তাপমাত্রা বিকিরণ করে শীতল হতে পারে, কিন্তু আকারে বড় গ্রহগুলো তা পারে না। গঠনের পর থেকে বড় গ্রহগুলোর ভেতরে প্রচুর তাপমাত্রা জমা হয়ে থাকে, সেগুলো বাইরে আসতে পারে না বিধায় গ্রহগুলো প্রচুর তাপ ছড়ায়। বৃহস্পতি, শনি, শুক্র এরা সকলেই সূর্য থেকে যে তাপ গ্রহণ করে, তার চেয়ে বেশি পরিমাণ তাপ বর্জন করে। বিস্ময়করভাবে, ইউরেনাস এখানেও ব্যতিক্রম।
নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী মার্ক হফস্ট্যাডটারের ভাষ্যমতে, ‘বড় গ্রহগুলোর মধ্যে ইউরেনাসই একমাত্র গ্রহ, যেটি সূর্য থেকে যে তাপ গ্রহণ করে, তার চেয়ে কম পরিমাণ তাপ বর্জন করে। আমরা এখনো এটার কারণ অনুসন্ধান করতে পারিনি’। নাসার বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, ইউরেনাস আর নেপচুনের গঠনগত বৈশিষ্ট্য অনেকটা একই রকম হওয়ার কথা, কিন্তু এখানে নেপচুন আর ইউরেনাসের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে।
হফস্ট্যাডটার বলছেন, ‘এখানে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি দেখা দিয়েছে সেটি হল, এই তাপ ইউরেনাসের অভ্যন্তরভাগে বদ্ধ হয়ে যাচ্ছে কিনা। যদি সেরকমটা হয়ে থাকে, তাহলে ইউরেনাসের অভ্যন্তরভাগ আমাদের কল্পনার চেয়েও অতিরিক্ত উষ্ণ হবে’। আবার অতীতে এমন কোন কিছু ঘটেছে কিনা, যার মাধ্যমে ইউরেনাসের অভ্যন্তরের তাপ কোন উপায়ে বাইরে বের হয়ে এসেছে, সেটিও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা।
আজগুবি কথা না, আসলেই ইউরেনাসের আকাশে হীরা বৃষ্টি হয়। আর সেই হীরা কোন ছোট ছোট হীরা নয়, রীতিমত ভালুকের সাইজের হীরা একেকটা। ইউরেনিয়াসের বাইরের অংশ ঠাণ্ডা হলেও যত ভেতরে প্রবেশ করা যায়, আবহাওয়া তত দ্রুত গরম হতে থাকে। অভ্যন্তরভাগে প্রচণ্ড চাপের কারণে সেখানে হীরা বৃষ্টি হয়ে থাকে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।
ইউরেনাসে যাওয়া পৃথিবীর একমাত্র মহাকাশযান নাসার ‘ভয়েজার-২’, ১৯৮৬ সালে ইউরেনাসে এই অভিযান চালায় নাসার বিজ্ঞানীরা। ৫০ হাজার মাইল উপর থেকে একবার অতিক্রম করেই বিজ্ঞানীরা ১০ টি নতুন চাঁদ ও ২ টি নতুন বলয় আবিষ্কার করেছিলেন সেবার বিজ্ঞানীরা। বাকি গ্রহগুলোর চেয়ে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের হওয়ায় ইউরেনাস বরাবরই বিজ্ঞানীদের আগ্রহের ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। গ্রহটির গঠন বৈশিষ্ট্য কেমন, এর ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, এর বলয়ের গঠন- এসব বিষয় জানার জন্য নতুন অভিযানের বিকল্প নেই।
ভয়েজারের মাধ্যমে ইউরেনাস সম্পর্কে গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল, কিন্তু বিশদ গবেষণার জন্য পুনরায় ইউরেনাসে মহাকাশযান পাঠাতে হবে। ভয়েজারের পর নাসা ১৯৮৯ সালে বৃহস্পতিতে ‘গ্যালিলিও’ ও ১৯৯৭ সালে শনি গ্রহে ‘ক্যাসিনি’ মহাকাশযান পাঠিয়েছিল। ভবিষ্যতে আবারও ইউরেনাসে মহাকাশযান পাঠানোর ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন নাসার বিজ্ঞানীরা।
মেন্টাল ফ্লস অবলম্বনে