ছোটবেলা থেকেই রূপকথার গল্পে এক শিংওয়ালা ঘোড়ার কাহিনী আমরা পড়ে এসেছি। এটার এমনই আকর্ষণ যে, বড় হয়েও কোথাও ইউনিকর্নের নাম শুনলে একটু ঢুঁ মেরে বসি উৎসটায়। লোককাহিনী এবং পুরাণে বর্ণিত বিভিন্ন পশুর মধ্যে বোধহয় ইউনিকর্ন এবং ড্রাগনের নামই সবচেয়ে বেশী উচ্চারিত। চলুন আজ তাহলে জেনে আসা যাক ইউনিকর্নের আদ্যোপান্ত।
পাশ্চাত্য সাহিত্যেই ইউনিকর্নের দেখা মেলে বেশি। সেখান থেকে আমাদের ধারণা হয়েছে, এরা আসলে সাদা রঙের ঘোড়া। স্বাভাবিক ঘোড়া থেকে এদের একটাই পার্থক্য – কপাল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা চোখা শিং। এই শিং কোন ছবিতে মসৃণ, আবার কোন ছবিতে প্যাঁচানো। একসময় এই শিংওয়ালা ঘোড়ার ছিল ব্যাপক দাপট। বিশেষ করে মধ্যযুগে। ইউরোপের মানুষ মনে করতো ইউনিকর্ন ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। দেখতেও বেশ আকর্ষণীয়। ধবধবে সাদা শরীরে লাল মুখমণ্ডল। চোখদুটো সাগরের মতো নীল। চারটি পা-ই অ্যান্টিলোপের মতো দেখতে। আর লেজখানা ছিল সিংহের মতো।
ইউনিকর্নের ক্ষীপ্রতা ছিল অসম্ভব বেশি। চোখের পলকেই ছুটে বেড়াত অরণ্য-প্রান্তর, পাহাড়-পর্বত সবখানে। সে যখন ছুটত তার সুন্দর একরাশ কেশর ফুলে-ফেঁপে উঠত সাগরের ঢেউয়ের মতো। আর শিংটাও ছিল দেখার মতো। গোড়া থেকে ডগা পর্যন্ত সাদা, কালো ও লাল। তার খুরের আঘাতে চিরে যেত যে কোনও বুনো প্রাণীর পেট। এমনকি বুনো হাতিও তার কাছে হার মানত।
এমন বুনো প্রাণীর দুর্বলতা ছিল কেবল একটা জায়গাতে- কুমারী মেয়ে। কোনও কুমারী মেয়ে দেখলেই তার পায়ের কাছে বা কোলে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়াত এই এক শিংওয়ালা ঘোড়া। আর কুমারী যদি সুন্দরী হত, তবে তো কথাই নেই। সুন্দরী কুমারীর কাছে এলেই বুনো এই ধবধবে ঘোড়া হয়ে যেত বেশ নম্র, উদার আর অনুগত। যেন কুমারীর পোষ মানার অপেক্ষায় রয়েছে কতকাল ধরে। সুন্দরী কুমারীদের প্রতি শিংওয়ালা ঘোড়ার এই দুর্বলতার সুযোগটাই নিত শিকারিরা। তাদের বিচরণভূমিতে রেখে আসত কোনও সুন্দরী কুমারীকে। তাকে দেখেই তার পায়ের কাছে বা কোলে শিশুর মতো আশ্রয় খুঁজত ঘোড়ারা। তখনই সুযোগ বুঝে ছুটে আসত শিকারি। শিকারি আসার শব্দে টের পেয়েও ছুটে পালাত না বুনো এসব ঘোড়া। একরকম স্বেচ্ছায় ধরা দিত। সে কারণে মধ্যযুগ থেকেই শিংওয়ালা ঘোড়াকে কুমারী মেয়েদের সদগুণের প্রতীক আর শুচিতা হিসেবে বিবেচনা করা হত।
বিবর্তনের ধারায় দুনিয়ায় অনেক বিচিত্র প্রাণীর জন্ম হয়েছিল। এসব প্রাণীর কিছু নানা কারণে অবলুপ্ত। কিছু টিকে আছে এখনও। ইউনিকর্নকেও মনে করা হয় তেমনি কোনও বিচিত্র প্রাণী। একসময় পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কারও কারও মতে আসলে ইউনিকর্ন নামে কোনও প্রাণীই দুনিয়ায় ছিল না। অ্যান্টিলোপ জাতীয় কোনও প্রাণীর সঙ্গে ঘোড়ার মিশ্রণে তৈরি মানুষেরই কল্পনার এক প্রাণী ছিল ওটা। তবে খৃষ্টপূর্ব আর খৃস্টপরবর্তী কয়েক শতকের বিভিন্ন গ্রিক ও রোমান পণ্ডিতদের লেখায় ইউনিকর্ন ছিল। ছিল ইউনিকর্নের প্রশংসাও। গ্রিক পণ্ডিতদের কেউ কেউ আবার একে ভারতীয় গাধাও বলেছেন। কারও মতে এটি আসলে বুনো গাধা। খৃষ্টানদের কাছে তো পবিত্র প্রাণী ইউনিকর্ন। তবে যতই পণ্ডিতদের লেখায়, আর্টিস্টদের আঁকায় আর ভাস্করদের ভাস্কর্যে ইউনিকর্ন আসুক না কেন, বাস্তবাদীরা কোনও মতেই ইউনিকর্নের অস্তিত্ব স্বীকার করতে রাজী নন। এর কারণও আছে। পৃথিবীর অনেক স্থানে নানা রকম প্রাচীন জীবের কথা জানা গেছে। সেটা ফসিলের মাধ্যমে অথবা প্রতিকৃতির নমুনায়। এখন পর্যন্ত ইউনিকর্নের কিছুই মেলেনি। তবে ইউনিকর্নের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলুক আর না মিলুক, হাজার বছরে ম্লান হয়নি এর চেহারা, বৈশিষ্ট্য আর গুণাবলি। মধ্যযুগে এর প্রতি ছিল ইউরোপিয়ানদের অগাধ বিশ্বাস আর সম্ভ্রম। তখনকার সময়ের তৈজসপত্র, রাজকীয় প্রতীক, মুদ্রা এসব কিছুতে ইউনিকর্নের উপস্থিতি ছিল ব্যাপক।
শিঙের জন্যই মূলত ইউনিকর্নের এত বিস্তার। এই শিং নিয়ে নানা বিশ্বাসের প্রচলন ছিল এককালে। কোন জলাশয়ের পানি কতটা বিশুদ্ধ সেটা শিং ডুবিয়ে নাকি পরখ করার ক্ষমতা ছিল ইউনিকর্নের। জলপান করার সময় যদি ইউনিকর্নের শিং পুরো পানিতে ডুবে থাকত, তবে ধরে নেওয়া হত পানিটা পুরোপুরি বিশুদ্ধ। ইংল্যাণ্ডের রাজবংশে দ্বিতীয় চার্লসের সময়ও পানপাত্রে থাকত ইউনিকর্নের মূর্তি। দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্বকাল ছিল ১৬৩০ থেকে ১৬৮৫ সাল পর্যন্ত। প্রাগের সম্রাট দ্বিতীয় রুডলফের পানপাত্রে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকত ইউনিকর্ন যেন সে পানীয়ের বিশুদ্ধতা পরখ করছে। কিছু কিছু রাজসভাসদের বিশেষ অনুষ্ঠানে খাবারের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা হত ইউনিকর্নের শিঙের উপকরণ।
অবিশ্বাস আর সন্দেহে ভরা ইউরোপিয়ানরা তখন ইউনিকর্নের মাধ্যমেই বিশ্বাস অর্জন করতে চাইত। যদিও সত্যিকারের ইউকির্নের শিং পেত না। সেগুলো তৈরি হত মূলত নরহোয়েল নামের তিমির দাঁত থেকে। স্কটল্যান্ডে ইউনিকর্ন ছিল সম্ভ্রান্ততার প্রতীক। স্কটিশ মুদ্রাতেও পঞ্চদশ আর ষোড়শ শতকে ইউনিকর্নের ছাপ ছিল। এখনও ‘ব্রিটিশ রয়েল হেরলডিক আর্মস’-এর অনেকগুলো প্রতীকের একটি ইউনিকর্ন। আরও হাজার বছর ইউনিকর্ন বেঁচে থাকবে আমাদের গল্প-গাঁথায়।