সারা বিশ্বের তরুণ প্রতিভাবান ফুটবলারদের স্বপ্ন লা মাসিয়া। নিজেদের এই একাডেমী থেকে নতুন সব সেনসেশন জন্ম দেয়ায় জুড়ি নেই বার্সেলোনার। এই লা মাসিয়া থেকেই উঠে এসেছেন লিওনেল মেসি, জেরার্ড পিকে, কার্লোস পুয়োল, জাভি হার্নান্দেজদের মত ফুটবলারেরা। তবে বার্সা যে শুধু নিজেদের একাডেমী থেকেই তরুণ প্রতিভা বের করে আনে, সেটাও না। অন্য ক্লাব থেকেও নিজেদের প্রয়োজনমত সম্ভাব্য সেরা তরুণ প্রতিভাদের ছেঁকে নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য ক্লাবে নিয়ে আসে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা এই ক্লাবটি। একবিংশ শতাব্দীতে বার্সার তেমনি সেরা কিছু টিন-এজ সাইনিং নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের পর্ব।
জেরার্ড গামবাউ- ২০১৪/১৫ মৌসুম
মূলত সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে খেলা এই ফুটবলারকে জিরোনা এফসি থেকে সাইন করায় বার্সেলোনা। ২০১৪ সালের ০১ জুলাই তিন বছরের চুক্তিতে বার্সায় আসেন এই তরুণ ফুটবলার। শুরুতে তাঁকে পাঠানো হয় বার্সার বি টিমে। বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি, পরের বছরেই লুইস এনরিকে মূল দলে অভিষেক ঘটিয়ে দেন গামবাউয়ের। কোপা দেল রে তে এলচের বিপক্ষে ৪-০ গোলে জেতা ম্যাচে বার্সার মূল দলের হয়ে প্রথমবারের মত মাঠে নামেন এই স্প্যানিশ তরুণ।
তবে লা লিগা অভিষেকের জন্য অপেক্ষা করতে হয় পরের মৌসুম পর্যন্ত। লেভান্তের বিপক্ষে ৪-১ এ জেতা ম্যাচে দ্বিতীয়ার্ধে সার্জিও বুস্কেটসের বদলি হিসেবে মাঠে নামেন গামবাউ।
তবে যেভাবে চেয়েছিলেন, ঠিক ততটা মসৃণভাবে নিজের ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিতে পারেননি তিনি। যেখানে তাঁর মূল দলের দরজায় কড়া নারার কথা, সেখানে তিনি কিনা আবারো ফিরে গেলেন বি দলে! সুযোগের অভাবে থাকা গামবাউ কিছুদিন আগে তিন বছরের চুক্তি করেছেন লেগানেসের সাথে।
অ্যালান হ্যালিলোভিচ- ২০১৪/১৫ মৌসুম
হ্যালিলোভিচের সাইনিং নিয়ে বোধহয় আনন্দের চেয়ে হতাশাই বেশি থাকবে কাতালান ফ্যানদের। এমন এক রত্নকে যে পেয়েও হেলায় হারিয়েছে বার্সেলোনা!
ক্রোয়াট এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ক্রোয়েশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে জাতীয় দলে অভিষিক্ত খেলোয়াড়। ইউরোপিয়ান ফুটবলে আগামীর তারকাদের মধ্যে অন্যতম প্রতিভাবান ফুটবলার মানা হয় যাকে, সেই হ্যালিলোভিচকে ২০১৪ সালে ডায়নামো জাগরেব থেকে ৫ বছরের চুক্তিতে দলে টানে বার্সেলোনা।
এমন এক প্রতিভাকে পেয়ে উল্লসিতই হয়েছিলেন বার্সা সমর্থকেরা, তবে সেই উল্লাস মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি মোটেও। সিনিয়র টিমের হয়ে কোপা দেল রে তে একটি ম্যাচ খেললেও বাকি সময়টা বি টিমের সাথেই কাটাতে হয় হ্যালিলোভিচকে। পরে এক মৌসুমের জন্য ধারে পাঠানো হয় স্পোর্টিং গিজনে। শেষমেশ প্রতিভাবান এই ফুটবলারটিকে গত বছর হামবুর্গের কাছে ছেড়েই দেয় বার্সা। হ্যালিলোভিচকে ধরে রাখতে পারলে হয়তো গত মৌসুমে মিডফিল্ড নিয়ে যেমন ভুগেছে বার্সা, তেমনটা ভুগতে হত না।
ক্রিশ্চিয়ান তেলো- ২০১০/১১ মৌসুম
লা মাসিয়া থেকে উঠে এলেও মূলত বার্সেলোনার নগর প্রতিদ্বন্দ্বী এস্পানিওল থেকে তেলোকে সাইন করায় বার্সেলোনা। প্রথম দুই বছর বি দলে খেলা তেলোর মূল দলে অভিষেক ২০১২ সালে, লা লিগার এক ম্যাচে আদ্রিয়ানোর বদলি হিসেবে নেমে খেলেন মিনিট পনেরোর মত।
সপ্তাহ খানেক পরেই লিগে প্রথম পূর্ণ ম্যাচ খেলার সৌভাগ্য হয় তেলোর। ম্যাচটি অনেক দিক থেকেই মনে থাকার কথা তার। মাঠে নামার ৮ মিনিটের মধ্যেই পেয়ে যান লিগে নিজের প্রথম গোল, তাও আবার লিওনেল মেসির পাস থেকে! ম্যাচটিও বার্সা যেতে ২-১ গোলে।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অভিষেকেও গোল পান তেলো, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার বদলি হিসেবে নামার ২ মিনিটের মধ্যে সেস্ক ফ্যাব্রিগাসের পাস থেকে জাল খুঁজে পান।
শুরুর পারফরম্যান্স দিয়ে সন্তুষ্ট করা তেলোর সাথে ২০১২ সালেই চার বছরের চুক্তি বর্ধিত করে বার্সা ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু নেইমার আসার পরে দলে জায়গা নড়বড়ে হয়ে যায় তেলোর। ফলশ্রুতিতে এফসি পোর্তোর কাছে ধারে পাঠানো হয় তাকে। এরপর ফিওরেন্টিনা ঘুরে তেলো আবার ফিরেছেন স্পেনে, বর্তমানে খেলছেন রিয়াল বেটিসের হয়ে।
ডেনিস সুয়ারেজ- ২০১৩/১৪ মৌসুম
আগামী মৌসুমে বার্সার মিডফিল্ডের অন্যতম ভরসা হতে যাওয়া ডেনিস ম্যানচেস্টার সিটি থেকে বার্সা বি তে যোগ দেন ২০১৩ সালে।
এক মৌসুম সেগুন্ডা ডিভিশনে বার্সা বি এর হয়ে খেলার পর ডেনিসকে ধারে পাঠানো হয় সেভিয়াতে। মূলত ইভান রাকিটিচকে সেভিয়া থেকে বার্সায় আনার চুক্তির অংশ হিসেবে ডেনিসকে দুই মৌসুমের জন্য ধারে সেভিয়ায় পাঠানো হয়।
২০১৫ তে বাই ব্যাক অপশন রেখে ডেনিসকে ভিয়ারিয়ালে বিক্রি করে দেয়া হয়। কিন্তু মাত্র ১ মৌসুম পরেই বাই ব্যাক অপশন কাজে লাগিয়ে ডেনিসকে ফিরিয়ে আনে বার্সা। চার বছরের চুক্তিতে পুনরায় বার্সায় আসা ডেনিসের দিকে ভালভাবেই নজর থাকবে আসন্ন মৌসুমে।
হাভিয়ের স্যাভিওলা- ২০০১/০২ মৌসুম
এই শতাব্দীতে বার্সার সেরা টিন-এজ সাইনিংগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলেন আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার হাভিয়ের স্যাভিওলা। দুরন্ত প্রতিভা দিয়েই বার্সা স্কাউটদের নজর কেড়েছিলেন ১৯ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকার। দুর্ধর্ষ গতিতে ডিফেন্স চেরা একেকটা দৌড়, ওয়ান ইন ওয়ান পরিস্থিতিতে দারুণ ড্রিবলিং ক্ষমতা ও বক্সের ভেতর নিখুঁত ফিনিশার হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যাওয়া এই তরুণ তুর্কিতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ১৫ মিলিয়ন পাউন্ডে রিভার প্লেট থেকে নিয়ে আসে বার্সা।
প্রথম মৌসুমেই দেখান নিজের পায়ের জাদু, অভিষেক মৌসুমেই লা লিগায় করেন ১৭ গোল, সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২০ এরও বেশি গোল! স্যাভিওলার জন্য বার্সায় আদর্শ এক ক্যারিয়ারই অপেক্ষা করে আছে বলে ধারণা করেছিলেন সকলে। কিন্তু দুঃখজনক হল, নিজের সামর্থ্যের পুরোটা এরপরে আর খুব কমই ঢেলে দিতে পেরেছেন এই আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড। প্রথম মৌসুমের পারফরম্যান্সই তাই হয়ে থাকে বার্সেলোনায় স্যাভিওলার সেরা মৌসুম!
এরপরে আর কখনোই মৌসুমে ২০ গোলের গণ্ডি পেরোতে পারেননি স্যাভিওলা। ফর্ম ফিরে পাওয়ার জন্য মোনাকো ও সেভিয়ায় ধারেও পাঠানো হয় তাঁকে, কিন্তু কিছুতেই আর পুরনো ফর্মের দেখা পাননি তিনি। শেষমেশ বার্সা ফ্রি ট্রান্সফারে তাঁকে ছেড়ে দেয় রিয়াল মাদ্রিদের কাছে। মাদ্রিদে গিয়েও বেঞ্চ গরম করা ছাড়া তেমন কিছু করতে পারেননি।
ক্যারিয়ার বাঁচানোর আশায় এরপর স্পেন ছেড়ে পর্তুগাল, ইতালি এমনকি গ্রীসেও গিয়েছেন, কিন্তু শুরুর সেই সম্ভাবনাময় স্যাভিওলাকে আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি। আলো ছড়িয়ে শুরু হলেও বার্সার ইতিহাসে তাই এক হারিয়ে যাওয়া তারা হিসেবেই লেখা থাকবে মেসির এই স্বদেশীর নাম।