আপনার কাছে যদি তাজমহল কেনার কোন প্রস্তাব আসে কি করবেন আপনি? খুশিতে পাগল হয়ে টাকার ব্যবস্থা করা শুরু করবেন নাকি ভাববেন কোন পাগলের পাগলামিতে সামিল হতে চলেছেন? আজকের দিনে কথাটি শুনে নিছক রসিকতা বলে মনে হলেও মাত্র কয়েক দশক আগে এমনটাই হয়েছিল তিন তিনবার!
তাজমহল দেখে মুগ্ধ হন ভারতে আসা ভিনদেশিরা। টাকা দিয়ে কত কিছুই করা সম্ভব। তা যদি তাজমহলটাও কেনা যেত ! এমন ভাবনা নিয়ে যারা তাজমহলে ঘুরে বেড়াতেন তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করে দিতেন এক ভদ্রলোক। তিনি নটবরলাল। নিজেকে সরকারি কর্মচারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে সম্রাট শাহজাহানের তাজমহল বিক্রি করেছেন তিনবার, লালকেল্লা বিক্রি করেছেন দুইবার, রাষ্ট্রপতি ভবনও বিক্রি করেছেন একবার!
শুধু তাই নয়, ৫৪৫ সদস্য নিয়ে ভারতের পার্লামেন্ট ভবনটাই বিক্রি করেছিলেন নটবরলাল। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরের পাঁচ দশক নটবরলাল নামটি ছিল ঠগবাজির প্রতীক। মানুষ ঠকিয়ে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিতে দারুণ দক্ষ ছিলেন তিনি।
নিজের কর্মকাণ্ডে ভারত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন নটবরলাল। এ নামটিও তাঁর আসল নাম নয়। ৫০টির মতো ছদ্মনাম ছিল তাঁর। মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তব তাঁর প্রকৃত নাম।
বিহারের সিওয়ান জেলার বানগ্রা গ্রামে ১৯১২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মানুষকে প্রতারিত করার নিত্য নতুন বুদ্ধির ভাণ্ডার ছিল তার কাছে। অন্যের স্বাক্ষর হুবহু নকল করার দারুণ প্রতিভা ছিলো এই লোকের, আম্বানী-বিড়লাদের মতো রাঘববোয়াল ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত আতঙ্কে থাকতেন, কখন তাদের স্বাক্ষর জাল করে টাকাপয়সা মেরে দেয় এই ঘাঘু ঠগ। ধীরুভাই আম্বানীর স্বাক্ষর জাল করে ব্যাংক থেকে টাকা আত্মসাতের অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
ডন সিনেমায় শাহরুখ খানকে খুঁজছিল এগারো দেশের পুলিশ, আর ভারতের আটটি রাজ্যের পুলিশ হন্যে হয়ে লেগে ছিলো নটবরলালের পেছনে। অন্তত শ’খানেক মামলা ঝুলছিলো ঘাড়ের ওপর, সর্বমোট সাজা হয়েছিলো ১১৩ বছরের। কিন্ত এই বান্দাকে আটকে রাখে এমন সাধ্য কার। নতুন নতুন কৌশলে জেল থেকে পালাতেন তিনি, একেকবার একেক উপায়ে। একবারও পুরো সাজা খাটার রেকর্ড নেই তার। তবুও বিভিন্ন সময়ে ধরা পড়েছেন, জীবনের বিশটি বছর কাটাতে হয়েছে জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। কিন্ত চরিত্র ঠিক হয়নি, বেরিয়েই আবার লোক ঠকানোর মিশনে নেমেছেন নতুন উদ্যমে।
পেশাগত জীবনে একজন আইনজীবী ছিলেন। তবে ওই পেশায় থিতু হননি। বরং বেছে নিয়েছিলেন মানুষকে ঠকানোর কাজ। সই জাল করতে পারতেন ভালো। আর একেই বেছে নেন মূলধন হিসেবে। তাজমহলসহ বিভিন্ন স্থাপনা বিক্রির জন্য বিদেশিদের কাছে পরিচয় দিতেন তিনি সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। বিক্রির প্রমাণ হিসেবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও দিতেন তিনি। আর এতে থাকত ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদেরসই।
কথার ভঙ্গি ও প্রতারণার অভিনব কারসাজিতে নিজেকে প্রায় অধরা করে তুলেছিলেন নটবর। সমাজসেবী হিসেবে তিনি লাখ লাখ অর্থ হাতিয়ে নিতেন। এ ছাড়া দোকানমালিকদের ভুয়া চেক দিয়ে লাখ লাখ টাকা ঠকিয়েছেন। ভারতের আটটি প্রদেশে ১০০টির মতো মামলা ছিল নটবরের বিরুদ্ধে।
১৯৯৬ সালে ৮৪ বছর বয়সে শেষবারের মতো গ্রেপ্তার হন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে নটবরকে কানপুর জেলখানা থেকে নয়াদিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস (এআইআইএমএস) হাসপাতালেরাখাহয়।
নটবর কবে মারা গেছেন সে সময় নিয়েও আছে হরেক তথ্য। তাঁর আইনজীবীরা জানিয়েছেন, ২০০৯ সালের ২৫ জুলাই তিনি মারাযান।যদিওতাঁরভাইগঙ্গাপ্রসাদশ্রীবাস্তবেরদাবি, ১৯৯৬ সালেই নটবরের মৃত্যু হয়।
নটবরকে ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা কনম্যান হিসেবে মানতেই হবে। গোয়েন্দা-পুলিশ সবাইকে যেভাবে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছেন তিনি তাতে তার কাহিনী মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত থাকবে আরও কয়েকশো বছর। বলিউডে নটবরকে নিয়ে বানানো চলচ্চিত্রে নটবর চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিগ-বি অমিতাভ বচ্চন।